আজ ২ জুন। আমাদের পরিবারের জন্য একটি অতি বিষাদময় দিন। যেমনটি হয়ে থাকে সারা দেশে বছরের প্রতিটি দিন কোনো না কোনো ত্রিশ লক্ষাধিক পরিবারে। অনেকের পরিবারে মন খারাপ করে থাকার মতো এখন হয়তো বা কেউ বেঁচে নেই। চার লক্ষাধিক সম্ভ্রম হারানো কোনো মা বোনকে কেউ লেখালেখি বা বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া মনে করে? ওদের পরিবারের সদস্যরাও সমাজের ভয়ে এই হতভাগীদের অস্বীকার করেছিলো। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা তাদের সর্বোচ্চ সম্মান বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলো, ধূলিসাৎ হয়েছিলো। রাষ্ট্র থেকে তারা কী পেয়েছিলেন? সমুখে না হলেও আড়ালে তাদের নিয়ে উপহাস করা হয়েছে। আর যারা প্রাণের দায়ে কেউ স্বজন হারানোর পরে বা পূর্বে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা যে মানবেতর জীবনযাপন করেছিলেন সেটি বোঝার ক্ষমতা ’৭১ পরবর্তী প্রজন্মের নেই। এমনকি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে যারা দেশে রয়ে গিয়েছিলেন. তাদের মধ্যেও একটি অংশ বোঝতে পারেনি, ভুল বললাম, বুঝতে চাননি, তারা কী ভুল কাজ করে যাচ্ছে ! এখনো বোঝে না। এরা এখনো মনে করেন তারা ঠিক কাজটিই করেছেন। হিন্দুদের সম্পত্তি লুটপাট করা, হিন্দু মেয়েদের খান সেনাদের হাতে তুলে দেয়া, এগুলো যুদ্ধে করা জায়েজ। সেই সময়ে এই অত্যাচার থেকে মুসলিম মেয়েরাও রক্ষা পাননি। যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলো এমন মুসলিম পরিবারও বাঁচতে পারেনি। যাদের সন্তানরা যুদ্ধে গিয়েছিলো। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের ভেতরে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই জালিমদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি।
আজ ২ জুন পিকেডির (প্রদীপ কুমার দত্ত) বাবা (আমার শ্বশুর) শহিদ হিরন্য কুমার দত্তকে ফটিকছড়ির নানুপুর গ্রামে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। তিনি যদি সময় মতো দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত তিনি নেননি। নিজের বাড়ি-ঘর, দেশ ছেড়ে কেইবা অকূল পাথারে গা ভাসিয়ে দিতে চায়? অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াতে চায়? তায় রয়েছে ছোটো ছোটো শিশু সন্তানরা। একমাত্র পুত্রসন্তান পিকেডি বছরখানেক আগে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। বড়ো মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়তো। বাকি দুজন মনে হয় ক্লাস টু থ্রিতে পড়তো। একেবারে ছোটোটি পুতুলের মতো মেয়েটি সবার কোলে কোলে ঘুরতো।
হিরন্য কুমার শহরের বাড়িতে থাকতে পারেননি। বাড়ি তাকে ছাড়তে হয়েছিলো। যখন চট্টগ্রাম শহরের পতন হয় ২৮ মার্চের দিকে। তবে এর আগে তিনি স্ত্রী-বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবেশী এক পরিবারের বাড়িতে। বাড়িতে ছিলেন তিনি, বুয়েটে পড়া তার সন্তান এবং ছেলেটির কাকু। ২৮ বা ২৯ তারিখের দিকে তিনি তার এক মুসলিম প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাই এবং ছেলেকে নিয়ে শহর ছাড়লেন। চট্টগ্রাম থেকে বের হওয়ার পথে ওদের চাক্তাই খাল পার হতে হয়েছিলো। এটি তখন পাক আর্মিদের দখলে ছিলো। প্রতিবেশী চাচা খুব ভালো উর্দু বলতে পারতেন। তিনিই পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলে সেই যাত্রায় সবাইকে নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছালেন।
হিরন্য কুমার এসে উঠলেন ধলঘাটে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে। এই ধলঘাটেই জন্মেছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। কে জানে তিনি হয়তো আকাশ থেকে নক্ষত্র হয়ে এই জানোয়ারদের কাজকর্ম দেখছিলেন এবং আর তার হাত নিশপিশ করছিলো যদি সেই পিস্তল দিয়ে এদের মাথা ফুটো করে দেয়া যেতো ! সেই সময়ে গ্রামেও কেউ নিশ্চিন্তে থাকতে পারতো না। কেনোনা এ দেশের কিছু জারজসন্তান মে মাসের কোনো এক সময় পাকিদের সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগঠিত হতে থাকে। বাঙালিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানিদের অত্যাচারকে রুখে দিতে চেয়েছিলেন, সে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রীস্টান যেই হয়ে থাকুন না কেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের মূল টার্গেট ছিলো হিন্দু জনগোষ্ঠী। পাকিস্তানি শাসকরা ধরেই নিয়েছিলো বাঙালিরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে ভারতের ইন্ধনে। আর এই কাজে সহায়তা করছে হিন্দুরা। এ ছাড়া, তারা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদের ইসলামে বিশ্বাসী বলে ভাবতো না। কেনোনা এরা ভাষার জন্য প্রাণ দিতেও পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রবীন্দ্রসংগীত গায়, কথায় কথায় মিছিল করে। টিয়ার গ্যাস, বেয়োনেট চার্জ, গুলি কিছুকেই ভয় করে না আর এসবের পেছনে রয়েছে ভারত, অতএব হিন্দু বাড়ি পেলে, হিন্দু পরিবার পেলে ওদের আর নিস্তার ছিলো না। তাদের দিতে হতো চড়ামূল্য। আর এইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের যারা যুদ্ধ করেছিলো, ছেলেদের আশ্রয় দিয়েছিলো রাজাকারদের লুকিয়ে অথবা ধরা পড়লে এর কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে সেটি জেনেও তারা নিজেদের সন্তানসম দামাল ছেলেদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি।
এটি ছিলো জেনোসাইড। একটি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বা একটি সম্প্রদায়কে চিরতরে বিলুপ্ত করে দেয়ার প্রচেষ্টাকে জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী এটিকে জেনোসাইড বলা হয়। তবে দুঃখের বিষয় নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষাধিক বাঙালিকে হত্যা করার পরে এবং চার লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দ্বিধা করেনি, বরং ইতরের মতো উল্লাসে ফেটে পড়েছিলো। দেশের ভেতরে নির্বিচারে গণহত্যা করেছিলো, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, এককোটি লোক প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলো প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এত কিছুর পরেও জাতিসংঘ আজ পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতিসংঘের ভূমিকা ছিলো যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করা। কিন্তু পাকিস্তানিদের বলেনি অবিলম্বে বাঙালিদের হত্যা করা বন্ধ করো। জানতে চায়নি সমস্যার শিকড় কোথায়?
হিরন্য দত্ত ছিলেন এই জেনোসাইডৈর শিকার। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে দিনের বেলায় থাকতে পারতেন না। পাহাড়ে পাহাড়ে পালিয়ে বেড়াতেন। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরে যেতেন। ছেলেরা সাধারণত এ রকম করতেন। এইভাবে আর কত পারা যায়? একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতে চলে যাবেন। সেই ভেবে নানুপুরে চলে এলেন। নানুপুরে মির্জাবু পরিবারের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন জেনারেল ম্যানেজার। মির্জাবু সাহেবের এক ছেলে ছিলেন ’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের থেকে নির্বাচিত এমপিএ। তার ছোটো ভাই পিকেডি’র বয়েসি, তিনি গিয়েছিলেন রণাঙ্গনে। হিরন্য কুমারকে তারা বহুবার খবর পাঠিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে চলে আসতে। ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন তারা। এমনকি মির্জা আবু মনসুর এমপিএ মার্চের শেষদিকে যখন দেশ ছাড়ছিলেন তখনো হিরন্য কুমারকে ডেকেছিলেন তার সঙ্গে চলে যেতে। তিনি তখন আমলে নেননি। নাকি চিত্রগুপ্তের খাতায় তার নাম তখনই উঠে গিয়েছিলো ত্রিশ লাখ শহীদের নামের সঙ্গে। কে জানে! মায়ার ছলনায় সব ভুলে গিয়েছিলেন।
মির্জাবু সাহেবদের বাড়িতে পৌঁছানোর পরের দিনই সম্ভবত পাকিস্তানি আর্মি সেই বাড়ি ঘিরে ফেলেছিলো বিশ্বাসঘাতক প্রতিবেশীদের সহায়তায়। মির্জা সাহেব রাতে বাড়িতে থাকতেন না। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিরন্য কুমার, তার ভাই এবং ছেলেকে আটক করে বাড়ির সামনের মাঠে এনে জড়ো করে। আরও অনেক লোককে ধরে এনেছিলো পাকি জানোয়াররা। তার বুয়েটে পড়ুয়া ছেলেকে ওরা চিনতো না। হিরন্য কুমারকে তখন তখনই আলাদা করে মাঠের একপাশে বসিয়ে রেখেছিলো। গ্রামে আর্মি এসে মানুষের ওপর অত্যাচার করছে শুনে শহরে অবস্থান করা ওই গ্রামের চেয়ারম্যান ছুটে এসেছিলেন গ্রামের লোকদের বাঁচাতে। তাকে পাকিস্তান বাহিনী আটক করলো। কেনোনা তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হতে চাননি। এক সময় বাকিদের বেদম মারধর করে ছেড়ে দিলো। সঙ্গে নিয়ে গেলো হিরন্য কুমার এবং ওই গ্রামের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদকে। খালপাড় পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে নূর মোহাম্মদের জন্য একটা গুলি খরচ করেছিলো। আর হিরন্য কুমারকে খালের পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে...কী আক্রোশ মেটালো জল্লাদবাহিনী কে জানে!
আজ সেই বিভীষিকাময় দিন পিকেডি’র পরিবার ও নূর মোহাম্মদ সাহেবের পরিবারের জন্য। এ ছাড়া, ওই অঞ্চলে আরও পাঁচজন শহীদের পরিচয় জানা গেছে। অতল শ্রদ্ধা শহীদদের প্রতি।
আমাদের দুর্ভাগ্য বাংলাদেশ আজও নয়মাসের হত্যাযজ্ঞকে জেনোসাইড হিনেবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। যদিও বড় একটি কাজ করেছে দেশে-বিদেশে প্রবল বাধা-বিপত্তির মুখেও কয়েকজন মানবতাবিরোধীদের বিচার কার্যক্রম ফাঁসির মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে। বিচারে শাস্তিপ্রাপ্ত একজন পলাতক রয়েছেন। একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে। একজন জেলে থাকাকালীন মারা গেছেন। বিচারকার্য এখনো চলমান আছে। এর মধ্যে কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের দ্বারা সংগঠিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের কাজ আমাদের দেশের কয়েকটি সংগঠন অক্লান্তভাবে করে যাচ্ছেন। এক পা দু’পা করে সাফল্যের দিকে তারা এগোচ্ছেন। আমাদের সরকারও এ নিয়ে কাজ করছেন। ৫২ বছর বয়সী একটি দেশ ২১ বছর উল্টো পথে হেঁটেছিলো। তার মানে এই নয় যে তারা সব উল্টে দিতে পেরেছিলো। ওরা সেরকম স্বপ্নই দেখেছিলো। কিন্তু সেটি যে সম্ভব নয়, অন্তত বাঙালি জাতির ইতিহাস তাই বলে না। এখানেই দালালরা বড় ভুল করেছিলো।
লেখক: ডা. অঞ্জনা দত্ত, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল।