প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পেরিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরশহরের বিদ্যাপীঠ দেবগ্রাম সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের। গেলো ৫ বছর আগে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হলেও নানা সমস্যায় জর্জরিত এই প্রতিষ্ঠান।
শতবর্ষী এই বিদ্যালয়ের নেই শহীদ মিনার, নেই সীমানা প্রাচীর। রয়েছে পর্যাপ্ত বেঞ্চের অভাব। কিছু বেঞ্চ ভাঙা। খসে পড়েছে ছাদের পলেস্তরা। শ্রেণিকক্ষের মেঝের আস্তরণ উঠে গিয়ে ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভেঙে ভেঙে পড়ছে দরজা-জানালা। রয়েছে শিক্ষক সংকট, যার ফলে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের সম্পদের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। চলতি বছরে এসএসসি পরীক্ষায় এই বিদ্যালয়ের পাসের হার ছিল ৫৪ শতাংশ।
সরেজমিনে সোমবার সকালে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন একটি ভবনের ছাদের বেশ কিছু অংশের পলেস্তরা খসে পড়েছে। শ্রেণিকক্ষের মেঝের কিছু কিছু জায়গার আস্তর উঠে গর্ত হয়ে গেছে। বেঞ্চ-টেবিল ভাঙা। জানালার গ্লাস ভাঙা। পর্যাপ্ত বেঞ্চ না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করছে। মেয়েদের কমন রুমের জানালার গ্লাস ভাঙা।
এসময় কয়েকজন ছাত্র ভাঙা বেঞ্চ দেখিয়ে বলেন, বেঞ্চ ভাঙার কারণে বই রাখা যায় না। কাঠের ভাঙা অংশের সঙ্গে আটকে শার্ট ছিঁড়ে যায়।
বিদ্যালয়ের অফিস সূত্রে জানা গেছে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পর্যন্ত এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকসহ ১৩ জন শিক্ষক আছে। গত ৩১ আগস্ট সহকারী প্রধান শিক্ষক অবসরে গেছেন। বর্তমানে শিক্ষকের ৫টি পদ শূন্য আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আখাউড়া লাল বাজার এলাকায় বিদ্যালয়ের চারটি দোকান আছে। দোকানগুলির ভাড়া মাত্র ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। যা আশে-পাশের দোকানের ভাড়ার চেয়ে অনেক কম।
এদিকে বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার, বাউন্ডারী ওয়াল না থাকায় হতাশ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। কয়েজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্কুলে শহীদ মিনার না থাকায় প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আখাউড়া শহীদ স্মৃতি কলেজ মাঠে গিয়ে উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানায় তারা।
আইয়ুব খান নামের এক অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বললেন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীরা আমাদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারবে। বড় হয়ে তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।
শতবর্ষের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করে ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মহসীন খান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরবময় ইতিহাস। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জানা উচিত। এজন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার থাকা দরকার।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি ব্যাচের এক ছাত্র দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানায়, আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই শুনে আসছি স্কুলে শহীদ মিনার নির্মিত হবে। একটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে এসেও আমাদের বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নেই। বিদ্যালয়ের মাঠে গবাদি পশু চরানো হয়। ক্লাস চলাকালে ছেলেরা খেলাধুলা করে। বিদ্যালয়ে পড়ালেখার মানও খারাপ। এজন্য তিনি প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব বলে মন্তব্য করেন এই প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ও পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য মো. বাবুল মিয়া দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বেসরকারি থাকাকালে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে তদারকি করেছি। এখন সরকারি হওয়ায় শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নাই। আমরাও বেশি কিছু বলতে চাই না। শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্ধ পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে।
দেবগ্রাম সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মাহফুজুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমি ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে শহীদ মিনার দেখিনি। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর শহীদ মিনার নির্মাণে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কমিটির সহযোগিতা না পাওয়ায় করতে পারিনি।
বাউন্ডারির ওয়ালের বিষয়ে কমিটির অসহযোগিতার অযুহাত দেখিয়ে তিনি বলেন, এখন স্কুল সরকারিকরণ হয়েছে। বিদ্যালয়ে কমিটি নেই। সরকারি আদেশ ছাড়া কিছু করা যায় না। শিক্ষক নিয়োগও দেয়া যাচ্ছে না। ইউএনও স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করে ছোটখাটো যে সব সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করবো।
বিদ্যালয়ের দোকানের ভাড়ার কমের বিষয়ে তিনি বলেন, দোকানগুলি অনেক আগের কমিটি ভাড়া দিয়ে গেছে। দোকানগুলোর অবস্থা ভালো না। তাই ভাড়া কম।
সার্বিক বিষয়ে আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও দেবগ্রাম সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি অংগ্যজাই মারমা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এসব বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।