৮ মার্চ ছিলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লিঙ্গ সমতার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়।বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য, নারীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উদযাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে পালিত হয় এই দিনটি।
এক সময় নারীরা সমাজে চরম অবহেলিত, লাঞ্ছনা, বঞ্চনার শিকার ছিলো। শুধুমাত্র শিশু পালন ও গৃহস্থালি-সংক্রান্ত কাজের জন্য বিবেচনা করা হতো।তবে এখন সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাদের সমাজের মূলধারার আলোকশক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তারা রাজনীতি, ব্যবসা, খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকাণ্ড, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছেন।এটা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক পদক্ষেপ। তারা সমাজের সর্বত্র এবং প্রতিটি স্তরকে আলোকিত করছেন।এগুলোকে লিঙ্গ সমতার প্রতিফলনের জন্য বিবেচনা করা হয়..যা সামাজিক উন্নয়ন এবং সমাজের অগ্রগতির জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে মূলত বিভিন্নভাবে নারীর উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং এটিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। তবে নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ হলো, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা নারীদের গ্রহণ করা, উৎসাহ প্রদান এবং অনুমতি দেওয়া।এটি রাজনৈতিক কাঠামো এবং আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ওপর জোর দেয়, এমন একটি আয়-বর্ধণ করার বিষয় যা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করে।এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সচেতনতা বৃদ্ধি, সাক্ষরতা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বাড়ানোর কাজও অন্তর্ভুক্ত করে। নারীর অগ্রগতি হলো, সমাজের বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে তাদের জীবন-নির্ধারক সিদ্ধান্ত নিতে সজ্জিত করা এবং অনুমতি দেওয়া।
একটি প্রবাদ আছে..আমাকে একটি ভালো মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি ভালো জাতি উপহার দেবো। মূলত শিক্ষিত মা একটি জাতির স্তম্ভ, আলোর দিশারী।তারা বিভিন্নভাবে বৃক্ষের মতো অবদান রেখে স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নারীদের শিক্ষাবৃত্তি বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের উন্নায়নের অগ্রণী পদক্ষেপ।স্থানীয় প্রশাসন যেমন ইউএনও, ডিসি, সচিব, ব্যাংকার, শিক্ষক, পুলিশ, বিচার, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং বিভিন্ন স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে ।পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে মোকাবিলা করার জন্য এটি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা সফলভাবে প্রতিটি সেক্টরে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছেন।তারা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা পুরুষের চেয়েও অগ্রগামী, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল।
নারীর অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়ন দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং লিঙ্গ সমতা অর্জন করার জন্য অপরিহার্য। অনেক বিশ্ব নেতা এবং পণ্ডিত যুক্তি দিয়েছেন..লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। টেকসই উন্নয়ন পরিবেশগত সুরক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গ্রহণ করে এবং ক্ষমতায়ন ছাড়া নারীরা পুরুষের মতো উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন না।
শিক্ষা নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তাদের আরও ভালো চাকরি খুঁজে পেতে সহায়তা করে এবং তারা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে উৎসাহী।তারা জনস্বার্থে যুক্তি তর্ক করে এবং স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য অধিকারের জন্য সরকারের কাছে দাবি পেশ করেন। বিশেষ করে, শিক্ষা নারীদের এমন পছন্দ করার ক্ষমতা দেয়..যা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য, তাদের সুস্থতা এবং সংগ্রামী জীবনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে উন্নত করে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও শিক্ষা সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ নয় এবং লিঙ্গ বৈষম্য এখনও বজায় রয়েছে।অনেক দেশে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়,শুধুমাত্র সীমিতসংখ্যক মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তা নয় বরং যারা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করছে তাদের জন্য শিক্ষার পথও ক্ষেত্র বিশেষে সীমিত।আরও বিশেষভাবে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষায় মেয়েদের কম অংশগ্রহণ এবং শেখার অর্জনকে মোকাবিলা করার জন্য আরও নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকা উচিত।
বাংলাদেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিলো যেখানে মাত্র ১০ ভাগ, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তা হয়েছে ৩৬ ভাগ।অর্থাৎ বেড়েছে ২৬ শতাংশ।কৃষি, তৈরি পোশাক, ব্যাংক, অফিস-আদালতসহ কর্মক্ষেত্রে প্রায় ৩৬ ভাগ নারী রয়েছে।শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে নয়, অনেক অপ্রচলিত ও উদীয়মান আনুষ্ঠানিক খাতে,যেমন হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং ও বীমা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।এর কারণ হচ্ছে,উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের নারীদের জন্য উচ্চমূল্যের চাকরির বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছে।
কিন্তু শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণের জন্য বেশ কিছু কারণ বাধা হিসেবে কাজ করে। অবকাঠামোর অভাব যেমন, পরিবহণ, টয়লেট, শিশু যত্নের সুবিধা এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার অভাব তাদের চাকরির বাজারে অংশ নিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।বাল্যবিয়ে আরেকটি কারণ..যা মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেয় না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশী নারীরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে।বিগত চার দশকে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, উন্নত চাকরির সম্ভাবনা, শিক্ষার বর্ধিত সুযোগ এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য নতুন আইন গৃহীত হয়েছে।যদিও নারীর অধিকার সংক্রান্ত বাংলাদেশের নীতি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত।২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন নারী। বাংলাদেশেও ১৯৯১ থেকে কোনো পুরুষ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হননি।
বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনসংখ্যার জন্য ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে, সাক্ষরতার হার পুরুষদের (৭৬.৬৭%) তুলনায় মহিলাদের (৭১.১৮%) কম।গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ তার শিক্ষানীতির উন্নতি করেছে এবং মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে।তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শিক্ষার গুণগত মান মোটেও বাড়েনি। ১৯৯০-এর দশকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের ভর্তির হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।যদিও এখন প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্তরে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা রয়েছে।তবে পরবর্তী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার সন্তোষজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ গত এক দশকে নারীর অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি রোল মডেল এবং এই বিষয়ে প্রচেষ্টার কারণে দেশটি সমাজে একটি প্রশংসনীয় পরিবর্তন অনুভব করছে।শিশু ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, দারিদ্র্যবিমোচন, নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো অনেক ক্ষেত্রেই গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্জন অনুকরণীয়।এক্ষেত্রে, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং তারা প্রায়শই একটি সহযোগিতামূলক ধারায় কাজ করেছে। জন্মহার হ্রাস করার জন্য পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছিলো এবং আয়-রোজগারের সুযোগ দেওয়ার জন্য ক্ষুদ্রঋণ চালু করা হয়েছিলো।গ্রামে গ্রামে এনজিও দ্বারা গ্রামীণ নারীদের সংগঠিত করা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার সেবা প্রদানের জন্য দ্বারে দ্বারে মহিলা কর্মীদের ব্যবহার শিশু, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং আয় উপার্জনের সুযোগের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের নারীরা ঘরের অভ্যন্তরে ঘরোয়া কাজ থেকে শুরু করে বাইরে বিবিধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’ ২০২২ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে,লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেরা পারফরম্যান্স করে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের মধ্যে শীর্ষ দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে।প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে..বাংলাদেশ তার সামগ্রিক লিঙ্গ ব্যবধানের ৭১.৪% বন্ধ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী ১৫৩টি দেশের মধ্যে ৭১তম স্থান পেয়েছে।জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে।জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন,এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কোর ‘শান্তি বৃক্ষ’এবং গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক মহিলাদের সাফল্যের হারও খুবই ঈর্ষণীয়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের চাকরির অর্জনও সত্যিই প্রশংসনীয়।ব্যবসায়, তারা কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে ভালো করছেন,কারণ তারা যে কোনও ব্যবসায় আরও জবাবদিহি, আন্তরিক, সৃজনশীল এবং নিবেদিত।সমাজে নারীর ক্রমাগত অবদান সামগ্রিকভাবে সমাজকে আলোকিত করার জন্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সত্যিই চিত্তাকর্ষক এবং এটি সমাজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে।সরকারের উচিত..তাদের অগ্রগতি ও নারীর ক্ষমতায়নের পথের জন্য তাদের সুদৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখা..যা তাদেরকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের গল্প হিসেবে দেখায়।কারণ, একজন শিক্ষিত মা শুধু নিজেকেই নয়,একটি পরিবারকেও, ধীরে ধীরে একটি সমাজ এবং অবশেষে একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আলোর পথ দেখায়, আলোকশক্তি হিসেবে কাজ করে।
লেখক : মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার