নতুন শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং হাইটেকের এই গ্লোবাল ফ্যামিলিতে উন্নত সমৃদ্ধ এবং মর্যাদাবান জাতি উপহার দেওয়ার জন্য শিক্ষা ব্যাবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক সৃষ্টির বিকল্প নেই। সরকার এবং জাতিসংঘ তাই একবাক্যে স্বীকার করেছে যে টেকসই এবং উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানব সভ্যতায় উষালগ্ন থেকে মানুষের সবচেয়ে যে পন্যটি মূল্যবান মনে হয়েছে সেটা হল শিক্ষা। এই শিক্ষা বিতরণ করে থাকেন একজন শিক্ষক।
তাকে যুগপোযোগী আধুনিক বিজ্ঞান মনষ্ক করার জন্য প্রশিক্ষন গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ SEDP- এর অন্তর্ভুক্ত Enhancing Professional Skills of Teacher- স্কিমের আওতায় ‘Induction Training for Non-cadre Govt College Teachers’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শিক্ষার উন্নয়ন, পরিকল্পনা, প্রশাসন, ব্যবস্থপনা এবং গবেষণা যার লক্ষ্য।
যার পরিপেক্ষিতে সেমিনার, সিস্পেজিয়াম, ওয়ার্কসপ, মিটিং, কো-কারিকুলাম কার্যকলাপ, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে করে থাকে। প্রক্ষিনার্থীরা এখান থেকে বাংলাদেশ প্রশাসন ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন অর্থনীতি, নৈতিকতা এবং মানবধিকার এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনেমি, স্মার্ট গর্ভনমেন্টস ও স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তোলা যায় শিক্ষার মাধ্যম। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দ্রুত আধুনিকায়ন ঘটেছে। আমরা যদি তাদের সঙ্গে তাল দিতে না পারি তাহলে বিচ্ছিন্ন উপজাতির মতো অবস্থা হবে।
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকেরা তাদের অর্জিত জ্ঞান নিজ নিজ কর্ম ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করবে। তারা তাদের অর্জিত জ্ঞান দ্বারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক করবেন এবং শিক্ষার্থীদের সেইভাবে শিখাবেন। আমরা Induction 6th Batch এর বিভিন্ন বিষয়ের ৪০ জন প্রশিক্ষনার্থী অংশগ্রহণ করি। বিবিধ বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রশিক্ষক এবং রিসোর্স পারসনদের সুচিন্তিত জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় প্রশিক্ষনার্থীগণ অনেক উপকৃত হয়েছেন। ৪৫ দিনব্যাপী চলমান এই কোর্সের সোনালী দিনগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই প্রশিক্ষণে মাইক্রোটিচিং নামক একটি ক্লাস নিতে হয়েছিলো। আমি দর্শনের শিক্ষক বলে দর্শন কী এর ওপর একটি ক্লাস নিয়েছিলাম। আমি ক্লাসে কী বলেছিলাম তা পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশে উপস্থাপন করা হলো।
দর্শন কী? জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে মানুষের যে অলঙ্ঘনীয় প্রশ্ন তার সন্তোষজনক উত্তরদানের চেষ্টার নাম দর্শন। দর্শন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন পিথাগোরাস। Philosophy শব্দটি Philos এবং Sophia শব্দ থেকে উৎপত্তি। Philos অর্থাৎ জ্ঞান Sophia শব্দের অর্থ ভালবাসা। অর্থাৎ যাদের জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা আছে। তারাই দার্শনিক।
আমরা যে M.Phil ও PhD করি M Phil মানে Masters of Philosophy. PhD শব্দের অর্থ Doctorate of Philosophy. সুতরাং কোনো কিছু চূড়ান্ত অবস্থাই Philosophy.
মানুষ পৃথিবীতে আসার পর বিস্ময় বোধ করেছে। এই বিষ্ময় থেকে প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে। আমি যে চলাফেরা করি লেখালেখি করি এই শক্তির উৎস কী? এটি কি ব্রেনের কাজ না আমার ভেতর কোনো শক্তি আছে? আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি আকাশ কতো দূরে অবস্থিত। এটা কে সৃষ্টি করেছে? এটা নীল কেনো? প্রভৃতি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার জন্য আবির্ভাব ঘটেছে দার্শনিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের। যার কারণে দার্শনিক থেলিসকে বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
বিজ্ঞানের সংজ্ঞা আমরা বলতে পারি। বিজ্ঞান হলো প্রকৃতির কোনো বিশেষ শাখাকে কেন্দ্র করে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করা হয় তাকে বিজ্ঞান বলে। প্রকৃতির হাজারও শাখা আছে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিটি শাখায় বিচরণ করা সম্ভব নয়। তাই বিষয়কে খণ্ডিত করে নির্বাচন করা হয়। যিনি জীব বিজ্ঞান জানের তিনি রসায়ন জানেন না। যিনি রসায়ন জানেন, তিনি পদার্থ বিজ্ঞান জানেন না। যিনি পদার্থ বিজ্ঞান জানেন, তিনি বিমান চালাতে পারবেন না। আর যদি বিমান চালাতে পারবেন, তিনি ট্রেন চালাতে পারবেন না। সুতরাং জ্ঞানের কোনো শেষ নেই।
জ্ঞানের শর্ত দ্বারা বৈধতা নিয়ে জ্ঞান বিদ্যা গড়ে উঠেছে। জ্ঞানকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা (১) বুদ্ধিবাদ (২) বিচারবাদ (৩) অভিজ্ঞতাবাদ (৪) স্বঞ্জাবাদ।
বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের জনক হলেও তাদের ভেতর মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির উপস্থিতির কারলে বিশ্বাস চলে আসা খুবই সঙ্গত। তাই তো বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যার কারণে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মুখে শোনা যায়, ‘মহাবিশ্বের বহুবিধ লীলা খেলা দেখে একজন নিবেদিত প্রান বিজ্ঞান কর্মীকে এটা মানতেই হবে যে অকল্পনীয় সেই শক্তি যা মানুষের চেয়ে সীমাহীনভাবে বড় এবং যার সামনে আমাদের নতযানু হতেই হবে।’
মহাকালের কবির মুখে শোনা যায় সীমার মাঝে অসীম তুমি বাঁজাও আপন সুর। আসলে মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে সে শুধু স্রষ্টাকে কল্পনাই করতে পারে। বাস্তবে প্রত্যক্ষ করা তার সীমানার অতীত বলে এটাকে রহস্যময় মনে হয়। আর যদি কেউ অভিজ্ঞতার আলোকে সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে প্রত্যক্ষ করার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে তাদের সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান শতাব্দির সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছে-
'If you want to know one micro gram salt you need 1000 Russels’ head.Õ এতো ক্ষুদ্র বস্তুর যদি এই রকম অবস্থা হয় তাহলে গোটা ইউনিভার্সের অবস্থা কি?
বাইবেলে বলা আছে, আজ থেকে চার হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু নৃ-বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, আজ থেকে প্রায় ৪০ লাখ বছর আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে বাইবেলে অসরতা প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার কারণে পাশ্চাত্য সমাজ ধর্ম ভিত্তিক কোনো মতাদর্শে তারা আর যেতে চায় না। তা ছাড়া বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ বানর থেকে সৃষ্ট এটা ডারউইন প্রচার করলে তারা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয় অথচ ডারইউনের মতামত ছিলো একটা প্রস্তাবনা মাত্র। কোনো কোনো বিজ্ঞানীরা নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য এমন সব ভ্রান্ত ধারণা দ্বারা তাড়িত হন, যে শেষ পর্যন্ত যেখানে বিজ্ঞানের ব-ও অবশিষ্ট থাকে না।
তিনি struggle for existence, Natural selection এবং Survival of The Fittest প্রভৃতির কথা বলেন। এখানে প্রাণীর নৈতিক চেতনার কোনো স্থান নেই। ফরাসী বিজ্ঞানী পি পি গ্রাসো ৩০ বছর ধরে গবেষণা করে এই মর্মে সিদ্ধান্তে এসে হাজির হয়েছেন যে অস্ট্রালোমেকাস আমল থেকে মানুষের পূর্ণতা প্রাপ্তিতে কমপক্ষে ৮০ হাজার প্রজন্ম গুজার গেছে। অথচ আজকের যুগের বানররা আদিম যুগের বানরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু বর্তমান নয় বরং সক্রিয়ভাবে কার্যকর। সুতরায় মানব বিবর্তনের বিষয়টি প্রশ্নাতীত থাকতে পারছে না।
শতাব্দির সর্বশ্রেষ্ঠ দাশনিক বার্ট্রান্ড রাসেল Why I am not a Christian বইয়ের ভূমিকা লিখতে যেয়ে বলেন, ‘I think all the great religions of the would Buddhism, Hinduism, Christianity, Islam and Communism both untrue and harmful’ আমরা আজকে সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিবর্তনবাদ ব্যাখ্যা কারতে যেয়ে বলতে চাই। সৃষ্টি একমাত্র স্রষ্টার জন্য্ মানুষ কোনো কিছুর স্রষ্টা নয়। সে ব্যবহারের উপযোগী করে সৃষ্টি করতে পারে। এক খণ্ড তৃণ খণ্ড এর স্রষ্টাও মানুষ নয়। মানুষ খেজুরের আটির পর একটা পর্দা আছে তার স্রষ্টাও মানুষ না। মানুষ গাছ কাটার কাঠ চীরে তৈরী করতে পারে খাট, পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি। কিন্তু কাঠের স্রষ্টা মানুষ না? আবার খনি থেকে লোহা গলিয়ে বের করা হয় তা দিয়ে ইঞ্জিন, বিমান, সাইবেল যন্ত্র তৈরি করা হয়। কিন্তু মানুষ যন্ত্রের আবিষ্কার করতে পারে কিন্তু লোহার স্রষ্টা মানুষ না। মানুষ শুধুমাত্র ব্যবহারের উপযোগী করে সৃষ্টি করতে পারে।
বিশাল এ সৃষ্টির জ্ঞান মানুষ আয়ত্ব করতে পারবে না। যদি কোন নাছোড় ব্যক্তি সৃষ্টিকে জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান বলে- We need a head as big as some 20000 billion light years diameter across only to understand the creation.’ আলো এক সেকেন্ড যায় এক লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। এক ঘণ্টায় এক সপ্তাহ এবং এক মাসে কত দূরে যায়। ২০ লক্ষ আলোক বর্ষে কতো দূর আর তা আজ ভাববার বিষয়। এতো বড় মগজ কারও হতে পারবে কি না চিন্তাও করা যায় না। সুতরাং সৃষ্টি জগতের জ্ঞান মানুষ কীভাবে ধারণ করবে?
দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে। আমরা যদি জীবনকে জানতে চাই জগৎকে জানতে চাই এমনকি জীবনকে উপলব্ধি করতে চাই তাহলে দর্শন জানার কোনো বিকল্প নেই। এই জানাটা চর্মচক্ষু দ্বারা জানা হতে পারে। আবার ওহীর মাধ্যমে জানা হতে পারে। যারা চাক্ষুষমান ব্যক্তি তাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার। তারা সত্য পথের দিশারী। আশা করি আধ্যাত্নবাদের সঙ্গে বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব মীমাংসা হবে। মানুষ পাবে মুক্তির ঠিকানা। এই বলে আমার মাইক্রোটিচিং ক্লাস শেষ করছি।
লেখক: প্রভাষক দর্শন বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, ঢাকা