নিয়োগ ও পিএইচডি জালিয়াত আবু হানিফাই আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার! - দৈনিকশিক্ষা

নিয়োগ ও পিএইচডি জালিয়াত আবু হানিফাই আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার!

মুরাদ মজুমদার ও রুম্মান তূর্য্য |

“আবু হানিফা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে উগ্র মৌলবাদী রাজনীতির ছাত্রসংগঠনে কাজ করতো। এমন অনেককেই বিএনপি-জামায়াতের শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে আবু হানিফা ওসমান ফারুকের স্লিপ নিয়ে চলে আসে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য-সচিব অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়াঁর কাছে। হানিফার চাকরি হয়ে যায় অবসর বোর্ডের মূল্যায়ন কর্মকর্তা হিসেবে। 

..…আবু হানিফা বিধি-বহির্ভুতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রাপ্তরা যেভাবে ধরা পড়েছে, অবসর বোর্ডেও আবু হানিফা ধরা পড়ে গেছে। অবসর বোর্ডে আবু হানিফার নিয়োগ সুস্পষ্ট অবৈধ। বোর্ড পরিচালনা পর্ষদের কোনও সভার সিদ্ধান্ত নেই, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি নেই, ইন্টারভিউ নেই, অন্যকোন প্রার্থী নেই। ডেকে এনে প্রথম শ্রেণির অফিসার পদে চাকুরি আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে হতে পারে না, তাই তদন্ত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে হানিফার নিয়োগ অবৈধ প্রমাণিত হয়েছে।”

“…স্যার, দৃষ্টির আড়ালে অনেক কিছু ফেলে রাখা যায়, কিন্ত ঐতিহাসিক কারণটিকে আড়াল করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় তথন রাষ্ট্রের বা সরকারের কোনো পর্যায়ে আবু হানিফা কিংবা তার মত ছদ্মবেশী অনুপ্রবেশকারীরা যেন নতুন করে কোথাও চাকুরী না পায় সেদিকে আপনাদের সুদৃষ্টি কামনা করি।”

আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে এমনটাই লিখেছেন অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য-সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি এই আবেদন করেন শরীফ সাদী। অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে আছেন আবু হানিফা। সংগে যোগ হয়েছে ডক্টরেট উপাধি। এহেন আবু হানিফা এখন ড. আবু হানিফা নামে পরিচিত।  

অবসর সুবিধা বোর্ডের মনোগ্রামে ছাত্রশিবিরের তরবারি যুক্ত হয় ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে। তৎকালীন সদস্য-সচিব সেলিম ভুইয়াঁর নিদের্শে মনোগ্রামে শিবিরের তরবারি যুক্ত করেন আবু হানিফা। মনোগ্রামটি দৈনিক শিক্ষাকে দেখাচ্ছেন অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী। সম্প্রতি তাঁর উদ্যোগে এটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।    

পাঠক, এবার চলুন দেখে আসি অবসর বোর্ডে আবু হানিফার নিয়োগ অবৈধ প্রমাণ হওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ”

“..পরীক্ষান্তে দেখা যায় আবু হানিফাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য অবসর সুবিধা বোর্ড সভায় কোনও রেজুলেশন হয়নি। এবং কোনও প্রকার পেপার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। অন্য কোনও আবেদনকারী ছিলো না। এ সংক্রান্ত নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়নি। কেবল তৎকালীন অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য-সচিব অধ্যক্ষ সেলিম ভুইয়ার স্বাক্ষরিত একটি নিয়োগ আদেশ আছে। তবে, নিয়োগ পরবর্তীতে অবসর সুবিধা বোর্ডের বিভিন্ন সভায় আবু হানিফার চাকুরি স্থায়ীকরণ নিয়োগে আদেশের বৈধতা প্রদান করা হয়েছে।”

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “প্রেষণে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদায়ন বিষয়ে অবসর সুবিধা বোর্ড সভার কোনও সিদ্ধান্ত নেই। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেষণে নিয়োগ পান এবং কর্মরত আছেন।”

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “অবসর সুবিধা বোর্ডে অস্থায়ীভাবে মূল্যায়ন কর্মকর্তা নিয়োগের কোনও সিদ্ধান্ত মো: আবু হানিফাকে নিয়োগাদেশ দেয়ার পূর্বে ছিল না। অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগেরও সিদ্ধান্তমূলে কোনও পেপার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি। কোনও নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়নি। নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্যকোনও আবেদনও করা হয়নি বিধায় আবু হানিফাকে মূল্যায়ন কর্মকর্তা পদে যথাযথ বিধি অনুসরণ করে অবসর সুবিধা বোর্ড কর্তৃক নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি।”  

তদন্ত কমিটিকে আবু হানিফা যা বলেছেন: “নিয়োগের জন্য কোন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি, দেয়ালে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। স্থায়ীকরণের সময়েও কোনও পেপারে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি। নিয়োগ কমিটি করা হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই।”   

পাঠক, আবু হানিফার মূল চাকরি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে। চাকরির ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দেখিয়ে নিয়োগ পান ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন। তখন বোর্ডের সদস্য-সচিব ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভুইয়াঁ। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসেও সেলিম ভুইয়াঁ একই পদে ছিলেন। আবু হানিফার চাকরি স্থায়ী হয় মে মাসেই। সেলিম ভুইয়ার শেষ কর্মদিবসে।

আবু হানিফা পদোন্নতি পেয়ে বোর্ডের সহকারি পরিচালক হন ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার পদে প্রেষণে চাকরি বাগান আবু হানিফা। আর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে হানিফার অবসর বোর্ডের মূল্যায়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগটি অবৈধ বলা হয়। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ) এ কে এম জাকির হোসেন ভূঁঞা।

তদন্তের শিরোনাম: “অবসর সুবিধা বোর্ডের মূল্যায়ন কর্মকর্তা পদে ড. মো. আবু হানিফার নিয়োগ, বর্তমান পদ সহকারি পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি এবং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপরেজিস্ট্রার পদ প্রেষণে নিয়োগ সম্পর্কিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন।” 

পাঠক, অবসর সুবিধা বোর্ডের সহকারি পরিচালক পদে চাকরির অভিজ্ঞতায় ভর করে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্টার পদে প্রেষণে নিয়োগ পান আবু হানিফা। হানিফার মূল চাকরিই অবৈধ বলেছে তদন্ত কমিটি, তাই আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার পদের চাকরিও অবৈধ। তবু এই হানিফাই অধিকাংশ সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদে ছিলেন। হানিফার বিরুদ্ধে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা পাইয়ে দিতে ঘুষ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। 

আরও দেখুন :  শিক্ষকদের অফিসে শিবিরের মনোগ্রাম (ভিডিও)

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

আরবি ভাষা জানেন না মাদরাসার মহাপরিচালক ও চেয়ারম্যান!

এবার দৈনিক শিক্ষার ময়নাতদন্ত শুরু হবে আবু হানিফার পিএইচডি জালিয়াতি নিয়ে। ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হন তিনি। তার গবেষণার শিরোনাম “বাংলার ইসলামী সংস্কৃতিক উন্নয়ন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে মসনদ-ই-আলা ঈসা খান এর অবদান (১৫৬৪-১৫৯৯খ্রি:)।”
এই বইটি থেকে কপি অ্যান্ড পেস্ট করেছেন আবু হানিফা 

মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন শাহজাহান নামের একজন লেখকের ‘ ঈসা খাঁ মসনদ-ঈ-আলা’ শিরোনামের বই থেকে প্রায় পুরোটাই কাট অ্যান্ড পেস্ট করেছেন আবু হানিফা। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর। প্রকাশনায়: ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষণা পরিষদ, কিশোরগঞ্জ। পরিবেশনায় সাহিত্যমালা, নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা।  মোশাররফ হোসেন শাহজাহান কিশোরগঞ্জ পৌরসভার সচিব ছিলেন। মোশাররফ হোসেনও জামাতপন্থী হিসেবে পরিচিত। আবু হানিফার নিজ জেলাও কিশোরগঞ্জ।   

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবু হানিফাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। 

পিএইচডি জালিয়াতি সম্পর্কে গতকাল (১৭ ডিসেম্বর) দৈনিক শিক্ষার এক প্রশ্নের জবাবে আবু হানিফার বক্তব্য: ‘পিএইচডির গবেষণা অনেক বই কাইটা-কাইটাই করতে হয়। আমার বিরুদ্ধে আনীত জালিয়াতির অভিযোগ অসত্য।’  

হানিফার নিয়োগ ও পিএইচডি জালিয়াতি সম্পর্কে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য-সচিব ও কিশোরগঞ্জ পৌর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ‘হানিফার নিয়োগ ও পিএইচডি—দুটোই জালিয়াতির মাধ্যমে। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হানিফাকে বরখাস্ত ও পিএইচডি বাতিলের উদ্যোগ নেয়ার দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।’  

‘ছাত্রলীগ করে, ওকে মেরে ফেল’ - dainik shiksha ‘ছাত্রলীগ করে, ওকে মেরে ফেল’ সিটি কর্পোরেশন এলাকাভূক্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ - dainik shiksha সিটি কর্পোরেশন এলাকাভূক্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় সবাইকে নজর রাখার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় সবাইকে নজর রাখার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর কমপ্লিট শাটডাউন ঘিরে কাউকে সহিংসতা করতে দেওয়া হবে না: কাদের - dainik shiksha কমপ্লিট শাটডাউন ঘিরে কাউকে সহিংসতা করতে দেওয়া হবে না: কাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সম্মানী নিয়েও প্রতারণা - dainik shiksha শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সম্মানী নিয়েও প্রতারণা দেশের সব ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা বন্ধের নির্দেশনা - dainik shiksha দেশের সব ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা বন্ধের নির্দেশনা সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ - dainik shiksha সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজসমূহ অনির্দিষ্টকাল বন্ধ - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজসমূহ অনির্দিষ্টকাল বন্ধ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকাল বন্ধ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকাল বন্ধ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00677490234375