২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের উচচ-মাধ্যমিক ও সমমানের কিছু সংখ্যক পরীক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা এক থেকে দুমাস পিছিয়ে দেয়ার দাবিতে রাজপথে নেমেছেন। তারা নিজেদের মতামত জানাতে পেরেছেন, এটা ভালো। কিন্তু, পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামাটা অবশ্যই অশনি সংকেত। উচচ মাধ্যমিক পরীক্ষা পেছানোর দাবি নিয়ে এভাবে রাজপথে নামার কালচার ইতোপূর্বে এভাবে দেখা যায়নি।
শিক্ষার্থীদের দাবি, এই ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নয়। আইসিটি পরীক্ষা বাদ দেওয়া হোক। সব পরীক্ষা ১০০ এর পরিবর্তে ৫০ নম্বরে হোক। পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হোক এক থেকে দু’মাস।
পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন আজকে নতুন নয়, এটি সেই যুগ যুগ ধরেই চলে এসেছে। এটি বেশি ঘটতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা তরুণ বয়সী। তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও হয়নি। তাদের অভিভাবক ও রাষ্ট্র তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ও এ জাতীয় অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। যারা এসব দাবি তুলছেন, তারা হয়তো মনে করেন, পরীক্ষা পেছালো ভালো হয়। বেশি নম্বর তোলা যায়। কিন্তু, যে সময়টা চলে যাচ্ছে, সেটার কি হবে।
আমার এক সহকর্মী বলেছিলেন, তারা যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তখন অনার্স পরীক্ষা পেছানোর জন্য শিক্ষার্থীরা মিছিল করে ভিসির অফিসে গিয়েছিলেন। ভিসি অফিস থেকে বের হয়ে তাদের জিজ্ঞেস করেছেন, কি হয়েছে তোমাদের? উত্তরে সমস্বরে সবাই বলে উঠেছিলেন ‘পরীক্ষা পেছাতে হবে।’ ভিসি উত্তর দিয়েছেন ’ দ্যা ডেট অফ ডেথ মে চেঞ্জ, বাট দ্যা ডেট অব এক্সাম উইল নেভার চেঞ্জ’। গো ব্যাক টু ইওর ডরমেটরিস অ্যান্ড স্টার্ট রিডিং’। শিক্ষার্থীরা হলে গিয়ে আন্দোলন বন্ধ করে বই পড়া শুরু করেছিলেন।
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। এক, সেই পাকিস্তান আমলেও শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলন করতেন। দ্বিতীয়ত, তখনকার ভিসিদের নৈতিক সাহস বেশি ছিলো। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সামনে ভিসি নিজে এসে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তার কথা ব্যক্ত করতে পারতেন। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীরাও এমন ছিলেন যে, ভিসি বলার পরপরই নিজেদের হলে ফিরে গিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন। ওই পরীক্ষা যথাসময়ই হয়েছিল। বিশবিদ্যালয়ের ম্যাচিউরড শিক্ষার্থীদের কথাও কিন্তু কর্তৃপক্ষ না শুনে তাদের সিদ্ধান্তেই পরীক্ষা নিয়েছিলেন। এখন কিন্তু এসব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ই নড়বড়ে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা হয়তো ভেবেছিলেন, কয়েক ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ করে রাখলেই সরকার তাদের দাবি মেনে নেবে। কিন্তু, কার্যত সেটা হয়নি।
আমরা আশির দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। তখন এরশাদের আমল। প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে একটানা কয়েকমাস নির্বিঘ্নে ক্লাস চলেছিল। শেষের দিকে কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচার জন্য সব বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলাম শীতের বন্ধ এগিয়ে আনার জন্য। আমরা চেয়েছিলাম, টানা ক্লাসের ধকল কাটাতে দু’একটা সপ্তাহ ক্যাম্পাসের বাইরে/ দেশের বাড়িতে কাটিয়ে আবার পুরো উদ্যেমে ক্লাস শুরু করব। কিন্তু আমাদের সিনিয়র ভাইয়েরা আমাদের তাড়া করলেন। তারা বলতে শুরু করলেন, ‘‘ আমরা তাড়াতাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে চাচিছ। আর তোমরা সেটা বিলম্বিত করতে চাচছ? আমাদের কারুর কারুর মাথা টাক হয়ে গেছে, আর তোমরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আন্দোলন করছো।
ধর ধর করে তাড়া দিয়েছে।’’ আমরা তাদের সাথে পারিনি। এখানে কর্তৃপক্ষকেও আসতে হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার অনুযায়ীই শীতের বন্ধ হয়েছিল। সেদিন বড় ভাইয়েরা যে কথা বলেছিলেন সেটিই ছিল বাস্তব। কারণ যতো তাড়াতাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া যায় ততোই মঙ্গল। নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য এবং দেশের জন্য। কারণ বাবা-মা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্রের ওপর ক’বছর শিক্ষার্থীরা নির্ভরশীল থাকবেন? তাদের কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হবে দ্রুত। এ বছরের এইচএসসি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলছি- সময়ের মূল্য বুঝতে হবে। দিন যত যাচেছ, প্রতিযোগিতা বাড়ছে। অতএব, কালক্ষেপণ না করে শিক্ষাজীবন শেষ করার চেষ্টা করুন। আপনারা জানেন না, উচচ শিক্ষায় কতটা সময় লাগবে। উচচ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকায় শিক্ষার্থীরা মোটামুটি সময় মতো বের হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সময়মতো বের হওয়ার কৌশল বা কালচার আমরা এখনও বের করতে পারিনি।উচচ মাধ্যমিকে যখন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে পড়ি, প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার জন্য পরীক্ষার তারিখ হলো। যথারীতি পরীক্ষা দিতে গেলাম। কিছু শিক্ষার্থী বন্ধু (মানবিক বিভাগের, আমরা ছিলাম বিজ্ঞান বিভাগে) রাস্তায় দাঁড়িয়ে বড় বড় তলোয়ার হাতে। যে পরীক্ষার হলের দিকে যাচেছ, ধাওয়া করছে। ইতোমধ্যে যে সব রুমে পরীক্ষা হওয়ার কথা সেসব রুমে তালা লাগিয়ে চাবি নিজেদের হাতে নিয়ে ঘুরছে। ঘণ্টাখানেক পরে অধ্যক্ষ একদল শিক্ষক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে এসে বললেন, কি হয়েছে তোমাদের। তোমাদের জন্য বিজি প্রেস, ঢাকা থেকে আমরা চাহিদা দিয়ে প্রশ্ন নিয়ে এসেছি, পরীক্ষা তো দিতেই হবে। তোমরা কিছু লিখতে পারো আর না পারো পরীক্ষায় বসো। পরে সবাই পরীক্ষায় বসেছিলাম।
এবারের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে দুইবার আন্দোলনে নামে। তাদের মধ্যে ছয়জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রায় আড়াই বছর সময় পেয়েছিলেন। আড়াই বছর সময় নিয়ে তাদের পরীক্ষা হয় ৫০ নম্বরের। কিন্তু ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে পরীক্ষার্থীরা মাত্র দেড় বছর সময় পেয়েছেন। এক বছর সময় কম পাওয়ার পরও তাদের পরীক্ষা ১০০ নম্বরে দিতে হবে। গত বছর আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার আইসিটি বিষয়েও পরীক্ষা দিতে হবে। আমরা আইসিটি বিষয়ে পরীক্ষা বাদ দেওয়ার দাবি করছি।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বোর্ডের এইচএসসি, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ভোকেশনাল, বি এম, বি এমটি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। এ তিন বোর্ডের পরীক্ষা আগামী ২৭ আগস্ট শুরু হবে। এটি হচেছ, অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু অন্য কারণে পরীক্ষা কেনো পেছানো হবে? বাকী বোর্ডগুলোর অর্থাৎ ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা যথারীতি ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হবে। এই পরীক্ষা উপলেক্ষ ১৪ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৩ দিন কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা ১৭ আগস্ট শুরু হচেছ। এ পরীক্ষা শুরুর তারিখ বহু আগে ঘোষণা করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী ১৩ লাখ ৫৯ হাজার পরীক্ষার্থীর বেশির ভাগ প্রস্তুতি নিয়েছেন। এর মধ্যে ছেলের সংখ্যা ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৭ জন এবং ছাত্রী সংখ্যা ৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৫৫ জন। ২ হাজার ৬৫৮টি কেন্দ্রে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সব পরীক্ষার আগে একটি অংশ বলে পরীক্ষা পেছাও। যারা মনে করে প্রস্তুত না। এখনো সময় আছে তারা কয়েকদিন যদি একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করে রাস্তায় না থেকে, আমি নিশ্চিত তাদের পরীক্ষা এতটা খারাপ হবে না। পরীক্ষা পেছানোর কোন সুযোগ নেই। যারা আন্দোলন করছেন তাদের দাবিগুলো যৌক্তিক নয়। আইসটি নিয়ে দাবি ছিলো। আইসিটি বিষয় সহজ করা হয়েছে করা হয়েছে। ১০০ এর পরিবর্তে ৫০ নম্বর করা হয়েছে।
মন্ত্রী তো যথার্থই বলেছেন। অর্ধ বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ হবে? নিজেদের ভবিষ্যত নিজেদেরই ফেস করতে হবে। অর্ধজ্ঞান দিয়ে সেটি করা সম্ভব নয়। এটা তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ভাষিক কমিউনিকেশন আর আইসিটির জ্ঞানই আপনাদের এগিয়ে নেবে। যে বিষয় কিংবা বিভাগেই পড়াশুনা করুন না কেন, এই দুটো বিষয়ে যাদের দখল বেশি, তারাই এগিয়ে যাবেন। প্রতিকুল পরিবেশে পরীক্ষা দিতে পারাও একটি পরীক্ষা।
আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ-ছাত্র সংঘর্ষ, সরকারি ছাত্র-সংগঠনের সাথে অন্যন্য ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষ, ঘন ঘন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা ছিলো সাধারণ ব্যাপার। ওই সময় আমাদের বিভাগের চেয়ারম্যান স্যার আমাদের টিউটরিয়াল ও টার্ম পরীক্ষাগুলোর তারিখ দিয়ে বলতেন, একদিকে লাশ পড়ে থাকবে। কিন্তু তোমাদের পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা পেছানো যাবে না। করেছিলেনও তাই। ওটাও এক ধরনের পরীক্ষা।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সব বন্ধ করে বসে থাকব, কিংবা পিছিয়ে দিয়ে দেব? সেটি কার জন্য? ক্ষতিটা কার? এসব ভাবতে হবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।