সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিন মাস আগে পাঠ্যপুস্তক ছাপা শেষ করার লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বান করেছে এনসিটিবি। কিন্তু কাজের ‘নিয়ন্ত্রণ’ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন ছাপাখানা মালিকরা। এতে বিপাকে পড়ছে এনসিটিবি। সংস্থাটি নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ করা নিয়ে শঙ্কিত।
এবার এনসিটিবি কাগজের ‘ব্রাইটনেস’ কিছুটা শিথিল করেছে। এতে ছাপাখানা মালিকরা সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক কম টাকায় দরপত্রে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রাথমিক স্তরের মোট ৯৮টি লটের কাজের ৯৫টিই সাত-আটটি ছাপাখানার মালিক পেতে যাচ্ছেন। এ কারণে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে এই কাজ দেয়া হচ্ছে। সোমবার (৩ জুলাই) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিক উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, প্রতিবারই পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ নিয়ে প্রিন্টার্সদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। তাতে কখনোই এনসিটিবি জড়ায় না। এনসিটিবির এ সংক্রান্ত কমিটিই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কাজ দেয়ার সুপারিশ করে।
প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়ায় কোন ছাপাখানাকে বিশেষ সুবিধা প্রদান বা কাজ পাইয়ে দেয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা নিজেরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দরপত্রে অংশ নিয়েছেন। এখন একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন এবং তাতে এনসিটিবিকে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা গত ২২ জুন সংগঠনের নয়াপল্টন কার্যালয়ে সম্মেলনে অভিযোগ করেন, দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে (ছাপাখানা) অস্বাভাবিক কাজ দেয়া, নির্ধারিত সময়ে বই না দেয়ার পরও জরিমানা না করা, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ দেয়া হচ্ছে। এসব অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রক জড়িত বলে সমিতির অভিযোগ। মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনীয়াবাত লিখিত বক্তব্য পাঠন করেন। এ সময় বিভিন্ন স্তরের ছাপাখানার মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির এসব অভিযোগকে ‘অমূলক’ ও ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রথমত দরপত্রের মূল্যায়ন কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। কোন প্রতিষ্ঠান কতটি লটের কাজ পাচ্ছে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত উন্মুক্ত দরপত্রে পাঠ্যবই ছাপার কাজ দেয়া হয়। এতে কোন প্রতিষ্ঠানের কাজ কমানো বা বাড়ানোর সুযোগ কারো থাকে না। তাছাড়া আমি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে নেই।’
তিনি জানান, গত বছরও তারা কিছু অভিযোগ করেছিল তা দুদক, প্রতিযোগিতা কমিশন এবং গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এনসিটিবি কোন ব্যক্তির ইচ্ছে-অনিচ্ছায় পরিচালিত হয় না। এর সব কিছুই আইন-কানুন ও সরকারি বিধিবিধানের আলোকে হয়।
কোন প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কাজ দেয়ার বিষয়ে অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘মেশিনের’ উৎপাদন সক্ষমতাসংক্রান্ত অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। এ নিয়ে হাইকোর্টে মামলার রায় আছে। সেটি অনুসরণ করা হয়েছে। যার যার সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ দেয়া হয় বলে তিনি জানান।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী (২০২৪) শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের দরপত্রে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। এবার দরপত্রে পাঠ্যপুস্তকের ব্রাইটনেস কিছুটা কমিয়ে ৮০ থেকে ৮২ রাখার কথা বলা হয়েছে। এই শর্তের কাগজ দেশেই উৎপাদন হয়। বিদেশ থেকে কোন কিছু আমদানির প্রয়োজন হবে না।
কিন্তু অনেক ছাপাখানা মালিক এই সুবিধা আমলে না নিয়ে বেশি দর হাঁকিয়ে দরপত্রে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ‘ধরা’ খেয়েছে। ছাপাখানা মালিকদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই দরপত্রের ওই শর্ত শিথিল করা হয়েছে কর্মকর্তারা জানান।
জানা গেছে, এবার প্রাথমিকের ৯৮টি লটের মধ্যে বেশির ভাগ লটের কাজ পাচ্ছে কচুয়া, ধলেশ^রী, অগ্রণী ও আনোয়ারাসহ সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী কাওসারুজ্জামান রুবেল বলেন, তিনি কোন ‘সিন্ডিকেটের’ সঙ্গে জড়িত নন। এই খাতে কে বা কারা ‘সিন্ডিকেট’ করে সরকারের অর্থ লুটে নেয়, তা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা জানেন।
পাঠ্যবই মুদ্রণের দরপত্র নিয়ে তাকে ‘সিন্ডিকেট’ করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল অভিযোগ করে রুবেল বলেন, তিনি ‘অনৈতিক’ পথে পা দেননি। এজন্য তাকে ‘টার্গেট’ করা হয়েছে।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির অভিযোগ, ২০২১ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের সব অনিয়ম ও জালিয়াতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পরিচিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গত শিক্ষাবর্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা বই ৮০ জিএসএমের স্থলে ৬০ জিএসএম দিয়ে ছাপানো হয়, যা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এগুলো এনসিটিবি জানার পরও ছিল নীরব।
সমিতির অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে এবার প্রথম থেকেই এনসিটিবির ভেতরে একটি অংশ সক্রিয় হয়েছে। তারা বাজারদরের চেয়ে বেশি প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করে। বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় ‘সিন্ডিকেট’ চাপের মুখে পড়ে। কিন্তু মুদ্রাকরদের একটি অংশ প্রাথমিক স্তরের বই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম দামে দরপত্র জমা দেয়। এতে একটি অংশ বিপাকে পড়ে। এ অংশটি এখন মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের কাজ পেতে মরিয়া। এজন্য প্রাথমিকের বেশি লটের কাজ যারা পাচ্ছেন তাদের ‘চাপে’ রাখতেই ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় বলে কয়েকটি ছাপাখানা মালিকের অভিযোগ। এছাড়া চলতি বছর যারা ‘নিম্নমানের বই’ সরবরাহ করেছে তাদের অনেকেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চলতি বছরের শেষের দিকে কিংবা আগামী বছরের শুরুর দিকে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এতে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম থাকতে পারে। এ কারণে অন্তত তিন মাস আগে অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পুরোপুরি শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এনসিটিবি। ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্তর এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অন্যান্য দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৩ থেকে ৩৪ কোটির মতো পাঠ্যবই ছাপার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এনসিটিবি।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের স্তরের মোট চার কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ শিক্ষার্থী ধরে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়। এসব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯২৩ কপি পাঠ্যবই ছাপায় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। প্রাক-প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বইসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হয়।