নব্বইয়ের ফুটবল বিশ্বকাপের টানটান উত্তেজনা। পাড়ার একমাত্র রঙিন টিভিতে খেলা শুরুর আগে ভিসিআরে একটা বাংলা সিনেমা দেখছিলাম। নায়িকা অপরাধ করে ধরা পড়েছেন নায়ক ও শাশুড়ীর কাছে। ক্রন্দনরত নায়িকাকে এখনই বাড়িছাড়া করার মতো প্রেক্ষাপট। পিন পতন নীরবতায় সবাই টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ হাবিবের মা বলে উঠলেন, ‘ওরে, পা ধর’। আমাদের সম্বিৎ ফিরলো। সিনেমায় ডুবে থাকা বাদবাকী দর্শকরাও হাসিঠাট্টা শুরু করলেন। নায়িকার ঘর রক্ষায় নায়কের পা ধরতে টিভি সেটের সামনে বসা দর্শকের পরামর্শ নিয়ে তুমুল আলোচনা।
কেউ বলছেন, গৃহকর্মী হাবিবের মা মনোযোগী দর্শক। কেউ বলছেন, নায়িকার ঘর ভাঙার আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে চিরায়ত গ্রাম-বাংলার নারীর পরামর্শই দিয়েছেন একজন ভক্ত-দর্শক। তিনি টিভি স্ক্রিনে দেখছেন সেটা হয়তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন। পা ধরার ঘটনা শুনলে বা জানলে সবার আগে আমার চোখে ভেসে ওঠে আজ থেকে ৩৪ বছর আগের সেই ঘটনাই।
আরও পড়ুন: কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে
২.
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালায় নারী প্রার্থীরা এসএসসি পাস ও পুরুষরা এইচএসসি পাস হলেই সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক হতে পারতেন। সরকারি প্রাথমিকের জন্য তার আগেও শর্ত মোটামুটি এমনই ছিলো। কিন্তু ১৯৯০ থেকে ’৯৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় বিভাগে এসএসসি যোগ্যতা নিয়ে নারী, এইচএসসিতে তৃতীয় বিভাগ নিয়েও পুরুষরা শিক্ষক হতে পেরেছিলেন। কারণ, বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বেকার যুবক-যুবতীদের শিক্ষাগত যোগ্যতায় ঘাটতি থাকলেও স্কুল প্রতিষ্ঠা ও সেগুলোতে প্রায় বিনাবেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে অঘোষিত সরকারি শিথিলতা ছিলো।
গত বছর ডিসেম্বরে কোনো রাখঢাক না রেখেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের এখন যারা পাঠদান করাচ্ছেন তাদের মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষক প্রায় ৮০ হাজার। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানে চরম বিড়ম্বনায় এসব শিক্ষক। এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষকদের স্বাভাবিক নিয়মে অবসরে যেতে লাগবে আরও ১৪ বছর।
৩.
প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় যারা নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন, তারা হঠাৎ স্কুল ভিজিটে গিয়ে উপরোল্লিখিত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে খুবই অবাক বনে যান। ইংরেজিতে ইংলিশ বানান পারেন না অমুক স্কুল শিক্ষক। এসব দেখে তারা অবাক বনে গেলেও এ লেখক প্রথমেই খোঁজ নেন ওই শিক্ষক কি প্রমাজর্ন পাওয়া সেই ২১ হাজারের একজন কি-না। অথবা বেসরকারি থেকে সরকারি হওয়া কেউ কি-না। দেশের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারেন না। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি। বিভিন্ন জরিপে এমনসব প্রতিবেদনেও চমকে যান না এই লেখক। না যাওয়ার অন্যতম কারণ সম্ভবত এই: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা পুরস্কাপ্রাপ্ত লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার বহুবছর শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে পড়ানোর পর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘অর্ধাক্ষর শিক্ষকরা সিকি অক্ষর শিক্ষার্থী তৈরি করছেন।’
যদিও এমন অযোগ্যতা সরকারিকৃত স্কুলগুলোর শিক্ষকদের মধ্যেই বেশি। আগের ৩৭ হাজার ৬০০ সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থা এতোটা খারাপ নয়।
৪.
নিবন্ধন সনদের ভিন্নতা, গ্রহণযোগ্যতা, পরীক্ষার মানের তারতম্য ও বয়সের বাধায় বিদ্যমান সব আইন ও বিধিবিধানে তারা এনটিআরসিএর চূড়ান্ত মেধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে বেসরকারি হাইস্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হওয়ার অযোগ্য। সংখ্যায় তারা কয়েক লাখ। তবু শিক্ষক হতে আবেদনের সুযোগ ও নিয়োগ পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন-নিবেদন, যোগাযোগ, সংবাদ সম্মেলন, মানবন্ধনসহ প্রায় সব ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন ও করছেন। হাইকোর্টে রিটও করেছেন।
মাধ্যমিক ও তদুর্দ্ধ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলে (প্রভাষক, সহকারি মৌলভী, সহকারি শিক্ষক) শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএর) বিবাদী করা হয়েছে। একদিকে রিট অপরদিকে রাজধানীর ইস্কাটনে এনটিআরসিএ অফিসের সামনে বিক্ষোভ আর কন্ঠ বিকৃত করে অডিয়ো ভাইরাল করে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে বিব্রত করা অপচেষ্টাও হয়েছে। আমরা দেখেছি, একদিকে যুক্তি নয় মানবিক কারণে নিয়োগলাভের সুযোগ দাবি, অপরদিকে বিক্ষোভ ও মানবন্ধন থেকে এনটিআরসিএ কর্মকর্তাকে ভুয়া ভুয়া ধ্বনি। ১ থেকে ১৫তম নিবন্ধিতদের ব্যানারে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করতে গিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কর্তাদের পায়ে ধরে কান্নার দৃশ্যও এখন ভাইরাল। গত ১৯ মার্চ ইস্কাটনের রাজপথে কর্তাদের পায়ে ধরে কান্নার সেই ভিডিয়ো সমাজ মাধ্যমগুলোতে ঘুরছে। পায়ে পড়া নিবন্ধনধারীদের অনেকের বয়স ৪০/৪৫ এরও বেশী।
‘৬৮ শতাংশ শিক্ষক ফেল কেন’! শিরোনামে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগস্ট এই লেখকের একটা উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিলো দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়। ওই বছরের একুশ আগস্ট প্রকাশিত দশম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিলো ৩২ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নেয়া সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর একটা বড় অংশ কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। আর ওই বছর এসএসসি পরীক্ষায় আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে গড় পাসের হার ছিলো ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। প্রথম আলোর সেই উপসম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তোলা হয়েছিলো, ‘পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া বেসরকারি শিক্ষক ও হবু শিক্ষকদের পাসের হার ৩২ শতাংশ হলে তাদের শিক্ষার্থী [এসএসসি] পাসের হার কীভাবে ৯২ শতাংশ হয়?
৫.
প্রাথমিক শিক্ষকরা ভালোভাবে পড়ান না তাই দুর্বল ছাত্র-ছাত্রী পান হাইস্কুল শিক্ষকরা। আর হাইস্কুলে ভালো পড়ান না তাই উচ্চ্চ মাধ্যমিকের প্রভাষকরা খারাপ ছাত্রছাত্রী পান। স্কুল-কলেজে কিছুই পড়াশোনা হয় না, তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা গর্ধভ ছাত্র-ছাত্রী পান। আবার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মূল্যায়নের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবে ঘটা করে ভর্তি পরীক্ষা নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে আলাদা পরীক্ষা দিতে হয় না। পূর্বেকার সনদেই ভর্তি করা হয়। এমন দোষারোপ ও ঘটনাবলি শুনে আসছি শিক্ষা সাংবাদিকতার গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে।
তবে, এতো এতো দোষারোপের অন্তত দুটো গ্রহণযোগ্য। ক. পাবলিক পরীক্ষা নিতে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপর শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ ভরসা করতে পারে না। কারণ দুটি। প্রথমত: পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা। শিক্ষকের মানসিক ও আর্থিক সততার ওপর ভরসা করতে না পারায় প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও উপজেলার কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হতে হয়। দ্বিতীয়ত: নিজ নিজ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ওপর প্রাইভেট টিউশনিতে না আসায় প্রতিশোধপরায়ণতা অথবা অবৈধ সুযোগদানের অবারিত সুযোগ। তাই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার্থীকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে পাশের কোনো প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে পরীক্ষায় বসতে হয় বহু বছর ধরে। এতোকিছুর পরেও গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়, পরীক্ষার্থীদের নকল দিচ্ছেন শিক্ষক : ভিডিয়ো ভাইরাল।
খ. পাবলিক পরীক্ষার কাংখিত মান ও নিরপেক্ষভাবে গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘটা করে ভর্তি পরীক্ষা নিতে হয়। ভোগান্তি হয় ভর্তিচ্ছুদের।
৬.
প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে পা ধরার মধ্য দিয়ে চল্লিশ/পঞ্চাশোর্ধ নিবন্ধনধারীদের নৈতিক মনোবল ও মানসম্মানের যে ঘাটতি হয়ে গেলো তা পূরণ হবে কি দিয়ে? এই যে পায়ে পড়া ও কান্নার ভিডিয়ো ভাইরাল হলো, যদি শেষতক শিক্ষক হতেই পারেন, তাহলে এমপিওভুক্তির জন্য আরেকবার তাদেরকে কারো না কারো পায়ে পড়তে হবে। আর তাদের শেষ জীবনে রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতোই সরকারিকরণের দায়েও পড়বে সরকার। বয়স ছাড়ের কারণে বঞ্চিতরা দুদকের স্মরণাপন্ন হলেও তো হতে পারেন।
আর পায়ে ধরার ভাইরাল ভিডিয়ো দেখে তাদের শিক্ষার্থীরা যদি গায়ে পড়েন? সরি বলার প্রয়োজন বোধ না করেন? তবে তাদের কিছু বলার থাকবে? দুই যুগ পরে আমাদের কি আবার লিখতে হবে যে, ভিডিয়ো দেখে কিছু ছাত্র গায়ে পড়ছেন পায়েপড়া সেই শিক্ষকদের! আবার মনে করতে হবে যতীন স্যারের উক্তি : ‘অর্ধাক্ষর শিক্ষকরা সিকি অক্ষর শিক্ষার্থী তৈরি করছেন’। নাকি স্যার আবার বলবেন, ‘সিকি অক্ষর শিক্ষকরা ফুটোপয়সার শিক্ষার্থী তৈরি করছেন!”
পায়ে পড়া শিক্ষকদের গায়ে পড়া শিক্ষার্থী লইয়া জাতি কি করিবে?
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।