পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলানোর হবে বলে মনে করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে তার মতামত প্রকাশিত হয়। এ সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মতামতটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
জ্ঞানের অনন্ত বিশ্বে পা ফেলার প্রস্তুতি ও অনুপ্রেরণা দেয় শিক্ষা। এটি দীর্ঘসময় নিয়ে হয় এবং এতে সাময়িক বলে কিছু নেই অথবা আকর্ষণীয় কোনো মোড় নেয়া নেই। শিক্ষা মনকে জাগায়, চিন্তা ও বোধের এলাকায় সমুন্নতি ঘটায়। বাংলাদেশের পক্ষে পুরোমাত্রায় সমকালীন হওয়ার জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন, তাকে হতে হবে সবচেয়ে সাম্প্রতিক, যদিও শিক্ষার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে একটা নিবিড় সংযোগ থাকতে হবে। শিক্ষা হবে বিষয়ভিত্তিক কিন্তু ব্যাপক, যাকে বলা যায় উদার মানবিক। মুখস্থনির্ভর, নোটবই-গাইডবই এবং টিউশনে পথ হারানো, শুধু লিখিত পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা সমসাময়িক হতে পারে না। তা হলে তা কীভাবে আমাদের আগামীতে পৌঁছে দেবে। বলাবাঁহুল্য, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সেই আগামীতে পৌঁছানোর জন্য তৈরি নয়। বর্তমান সময়কেই তা ধারণ করতে পারছে না, নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং উঁচুমানের যত দক্ষতা ও যোগাতার সমাহারে ক্রমিক সমুন্নতি সম্ভব যেসব পথে, সেসব পথে তা হাঁটবে কী করে?
আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এই সমস্যা ও সহিংসতাসংকুল পৃথিবীতে কোনো দেশই কোনো দেশের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই আমাদেরও নির্ভর করতে হবে আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর। সেই শক্তি শুধু অর্থনীতির শক্তি নয়, এটি এক সম্মিলিত শক্তি যা মেধা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ ও সংস্কৃতি, উদ্ভাবন ও নতুন চিন্তা, প্রকৃতি ও পরিবেশের মতো অনেক ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের যোগফল। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রসর হওয়ার কথা বলি, কিন্তু এই প্রযুক্তি কি আমরা তৈরি করি? আমরা কৃষির ক্ষেত্রে অগ্রগতির পরিসংখ্যান দিই, কিন্তু কৃষিপ্রযুক্তির কতটা আমাদের উৎপাদন। আমরা পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত হই, কিন্তু পরিবেশকে সুখ রাখার কয়টা উপায় আমরা আবিষ্কার করছি।
আমাদের শিক্ষাকে বাজারবান্ধব করার জন্য উদারবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা তাদের নানা সংস্থার (যেমন, বিশ্বব্যাংক) মাধ্যমে আমাদের চাপে রাখেন, কিন্তু এই বাজার কি আমাদের শর্তে চলে, না পশ্চিমের। আমরা এখন ব্যস্ত শিক্ষাকে চাকরিজীবী এবং কর্মকর্তা করার দিকে পরিচালিত করতে। চাকরিজীবী আর কর্মকর্তারা কখনো পরিবর্তন আনতে পারেন না, তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়মমাফিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ছাড়া কিছু করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওপরে যেসব ক্ষেত্রের উল্লেখ করা হলো, তার প্রতিটিতে সবচেয়ে সাম্প্রতিক জ্ঞান ও দক্ষতা লাভের জন্য যেসব প্রস্তুতি আমাদের থাকার প্রয়োজন, তা আমাদের অর্জিত হয় না নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য; যার মধ্যে আছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অনুপস্থিতি, প্রয়োজনীয় অর্থের অপ্রতুলতা এবং শিক্ষা প্রশাসনে গতিশীলতার অভাব।
একুশ শতকের শিক্ষায় ভাষা ও গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান, পরিবেশ ও কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং যোগাযোগ দক্ষতাসহ নানা বিষয়ে সবচেয়ে সাম্প্রতিক জ্ঞান ও দখল থাকাটা এক আবশ্যিক শর্ত। অথচ আমাদের ভাষাশিক্ষা ত্রুটিপূর্ণ- মাতৃভাষাতেই বলা ও লেখার দক্ষতা আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নেই। ফলে অন্য কোনো ভাষায় তাদের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। গণিত ও বিজ্ঞানে আমাদের শিক্ষার্থীদের দখল কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। তাদের যোগাযোগ দক্ষতা নিম্ন পর্যায়ের। গ্রাম শহরের, উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মধ্যে বৈষম্য প্রকট। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক ডিজিটাল বৈষম্য। মেয়েদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়ান, তাদের এক বড় অংশের ভাষাজ্ঞান দুর্বল।
তা ছাড়া মুখস্থনির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতার অনেকটাই অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। আমাদের চাই ভালোমানের স্কুল, সেই স্কুলগুলোতে থাকবে উন্নত গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, অডিটোরিয়াম, খেলার মাঠ। আমাদের চাই সত্যিকার সৃজনশীল, উদ্ভাবনী শিক্ষা, চিন্তায় গভীরতা, দক্ষতার সর্বোত্তম প্রকাশ। চাই উন্নত পাঠ্যবই, এরা প্রশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষক এবং আনন্দিত পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ। এ জন্য পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলাতে হবে এবং-তা করার জন্য প্রয়োজন কয়েকটি আবশ্যকতার বাস্তবায়ন। এগুলো হচ্ছে শিক্ষাকে একুশ শতকের উপযোগী করার জন্য রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অব্যাহত সমর্থন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়ন, শিক্ষার আমূল পরিবর্তনের জন্য একটি সাহসী নীতি, মেধাবী শিক্ষকদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করা, বিদ্যায়তনগুলোর সঙ্গে সমাজের গূঢ় সংযোগ তৈরি করা, সেগুলো পরিচালনা এবং সার্বিকভাবে শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতি নির্মূল করা, পাঠ্যক্রমকে আকর্ষণীয় করা এবং পরীক্ষার বোঝা কমিয়ে, মুখস্থ বিদ্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে, নোটবই ইত্যাদিকে বিদায় দিয়ে, টিউশনকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় করে চমৎকার একটা শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ এবং শিক্ষা প্রশাসনকে বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে আনা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জীবনদক্ষতাসহ সব ধরনের দক্ষতার উন্নতি ঘটিয়ে বই পড়ার প্রতি তাদের আকৃষ্ট করে, সাংস্কৃতিক নানা চর্চায় তাদের উৎসাহিত ও জড়িত করে, খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে শিক্ষাকে তাদের মালিকানায় তুলে দেওয়া।
অত্যাবশ্যক যেসব কাজের তালিকা দেওয়া হলো- যেগুলোর অনুপস্থিতিতে শিক্ষা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই পড়ে থাকবে। তবে আমার বিশ্বাস, এর সব কাটি করা আমাদের পক্ষে সম্ভাব।
এক করপোরেট কর্তাকে তার এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে জরুরি কাজটা তার করার কথা, তা কবে করে দিতে হবে। কর্তা বলেছিলেন, গতকাল। অর্থাৎ এক মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। আমাদেরও এই কথাটা মনে রাখা উচিত। আমার দুঃখ, সাধ্য থাকলেও শিক্ষায় উন্নতি ঘটানোর সাধ আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। যেদিন হবে- হতেই হবে, কারণ তা না হলে আমরা একুশ শতকের দৌড়ে পা হড়কে পড়ে যাব- সেদিন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
আমাদের মেধা আছে, মেধার কমতি নেই, কিন্তু মেধার লালন হয় না। আমার ৫০ বছরের শিক্ষকতায় দেখেছি- প্রত্যন্ত, অবহেলিত এক জনপদ থেকে উঠে আসা একটি ছেলে বা মেয়ে অনেক দ্বিধা এবং অসম্পূর্ণতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে কী চমৎকারভাবে নিজেকে মেলে ধরেছে। আমি নিশ্চিত, সারা বাংলাদেশে যদি আমরা সেই শিক্ষা দিতে পারতাম, যার একটি অতি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা আমি এই লেখায় দিয়েছি, তাহলে মাত্র এক-দেড় দশকে দেশাটি একুশ শতকের গুনা শুধু তৈরিই হতো না, অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেও সঙ্গম মনে রাখতে হবে।