প্রত্যাশা বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা - দৈনিকশিক্ষা

প্রত্যাশা বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা

অধ্যাপক মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ |

বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অতীতে প্রস্তাব, পর্যালোচনা, আশ্বাস আবর্তীত হয়েছে অনন্ত অপেক্ষার অনিশ্চিত পরিক্রমায়। মানুষের অধিকারের কান্না এ মুহূর্তে সরকারের বিড়ম্বনার কারণ না হোক, এ বিষয়ে সবাই অত্যন্ত সচেতন। অথচ বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় এমপিও, নন-এমপিও হাহাকার শিক্ষাক্ষেত্রে করুণ বৈপরীত্যের বার্তা দিচ্ছে। এখানে প্রধান উপদেষ্টার মনোযোগ আকর্ষণ করা দরকার, তিনি মানুষের কষ্ট লাঘবে সারাজীবনই যথেষ্ট আন্তরিক, এতে সন্দেহ নেই। এজন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি, এমপিও বা নন-এমপিও নামক পীড়াদায়ক পরিভাষা অবলুপ্তি হওয়া জরুরি।

আমি আমার পেশাগত অভিজ্ঞতার প্রায় বত্রিশ বছরের বাস্তবতায় দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের পথচলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের চূড়ান্ত গন্তব্য।

বেসরকারি শিক্ষকদের যাপিত জীবনের পরতে পরতে না পাবার না হবার জ্বালাময় হাহাকার। এ জন্যই কখনো দেখা গেলো, প্রাইমারির শিক্ষক, তো পরক্ষণেই বেসরকারি শিক্ষক। কখনো শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি। কখনো জাতীয়করণ আত্মীকরণ দ্বন্দ্ব, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার প্রসঙ্গ। কখনো অনার্স, মাস্টার্সের শিক্ষকের এমপিওভুক্তি। কখনো নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি। 

এমপিওভুক্তদেরও আছে বঞ্চনা দীর্ঘ আখ্যান। আছে, মাদরাসা শিক্ষকদের কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। দিনে দিনে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও কষ্ট বাড়ছে এবং জটিলতর হচ্ছে সমাধানের সব প্রয়াস। শিক্ষা জাতীয়করণ এজন্যই প্রয়োজন, মানুষ গড়ার কারিগরকে এমপিওভুক্তির নামে দেয়া হয় ‘অনুদান’। 

বেসরকারি শিক্ষকদের প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছে-বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিতভাবে স্কুল কলেজ জাতীয়করণের পরিবর্তে সুনিদির্ষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে শিক্ষা জাতীয়করণ করা, সিলেবাস অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ও অনার্সসহ স্কুল, মাদরাসা, কলেজের সকল স্তরের নন-এমপিও শিক্ষকদের শীঘ্রই এমপিওভুক্ত করা, কর্মরত সব শিক্ষকের চাকরির মেয়াদকাল ৬০ থেকে ৬৫ বছরে উন্নীত করা। এমন বাস্তবতার মধ্যে এক ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ‘সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ’।

‘জাতীয় লজ্জা’ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব ভাতা। শত আশার কাল্পনিক হিসাব কষে আমরা রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতায় পরিশোধ করি আয়কর; ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায় দেই কোরবানি। অথচ, রূঢ় বাস্তব হলো ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতায় কোরবানির ন্যূনতম ব্যয় সংকুলান হয় না।

অভিন্ন সিলেবাসে পাঠদানকারী প্রায় শতভাগ বেসরকারি শিক্ষক নানান বঞ্চনা শিকার। শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতনের শতভাগ রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করা হলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরাই বিশ্বের একমাত্র পেশাজীবী যারা ২০০৪ খ্রি. হতে মূল বেতনের ২৫ শতাংশ উৎসবভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশের অপর কোনো পেশায় ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা নেই। তবে এমপিওভুক্ত কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা পান। ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে অত্যন্ত বেমানান। আইনজীবী, বিচারক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র বা অন্যান্য পেশাজীবীর অভিজ্ঞার যেমন মূল্য-মূল্যায়ন শিক্ষকদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। 

দেশের সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা বাড়িভাড়া মূলবেতনের ৪০-৪৫ শতাংশ বা বেশি পান। এমপিওভুক্তদের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পদের (পিয়ন হতে প্রিন্সিপাল) সবাই একই পরিমাণ ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া পান। তারা পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ও উৎসবভাতা, স্বেচ্ছা অবসর, বদলি সুবিধাসহ অসংখ্য বঞ্চনার শিকার। 

এমপিওভুক্ত কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ হতে হলে প্রার্থীকে নতুন করে চাকরি খুঁজতে হয়। আছে নানান শর্তের জটিল বেড়া জাল। চাকরি পেলে ছাড়তে হয় আগের পদ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থা খুবই নাজুক। 

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিস সম্মেলনে ১৩টি অধ্যায় ও ১৪৬ টি ধারা-উপধারায় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য প্রণীত সুপারিশে শিক্ষকের চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি বেতন-ভাতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বলা আছে: ক. সম্মানজনক পারিতোষিক নিশ্চিতকরণ খ. যুক্তি সংগত জীবনমান বিধানকল্পে সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ গ. স্কেল অনুযায়ী নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ঘ. জীবনধারণের ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাস ও বর্ধিতবেতন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ইত্যাদি। 

রূঢ় সত্য হলো, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র বেতন বেশি অথচ শিক্ষকের বেতন ও সুযোগ সুবিধা কম, অন্যদিকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র বেতন কম অথচ শিক্ষকের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বেশি। সার্বিক বিচেনায় ‘সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে’ বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতা চালু করা বিশেষ প্রয়োজন।

প্রধান উপদেষ্টা প্রতিশ্রুত বদলে দেয়া ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশে দারুণ অনগ্রসর ও করুণ পেশাজীবীর আখ্যান ‘বেসরকারি শিক্ষক’। ‘মানুষ গড়ার কারিগর’দের জীবনমান অনুন্নত থাকলে, কারিগরকে অভুক্ত, অবহেলিত রাখলে জাতি হয়ে ওঠবে অবনমিত ও নিম্নগামী। ওইসব মানুষদের আকাঙ্ক্ষা যেনো অনন্ত হাহাকার হয়ে শূন্যে মেলাবে না এটারই  অপেক্ষা।

লেখক: শিক্ষক, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর 

 

মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045390129089355