কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা কোনো অফিসের ইউনিট প্রধান অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার অসীম ভালবাসা প্রদর্শন করার জন্য এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেন যা একজন সুপারভাইজার হিসেবে কোনোভাবে অফিসিয়াল কথা নয়। তারা তাদের কথাবার্তায় অফিসের প্রতি, প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের মেকি ভালবাসা প্রদর্শন করতে চান। তারা দেখাতে চান যে, অফিসকে, প্রতিষ্ঠানকে তারাই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন, অফিসের অন্য কেউ নন। এটি তাদের এক ধরনের অদক্ষতা ও নিজেদের দোষ ঢেকে রাখার এক ধরনের কৌশল। আধুনিক অফিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম হচেছ ‘সার্পোটিভ সুপারভিশন’। শুধু অন্যের দোষ ধরা, অন্যকে ছোট করা, সহকর্মীদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অন্যের সামনে তার দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরা যেগুলো সাধারণত অফিসের অনেক বস করে থাকেন।
সার্পোটিভ সুপারভিশনে একজন বস তার সহকর্মীদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন এবং সেই আচরণের মধ্যেই মানুষমাত্রই যে ভুল হতে পারে সেই থিওরি অনুযায়ী গঠনমূলক ফিডব্যাক দেবেন। একজন সহকর্মী যদি প্রকৃতঅর্থেই তার বসকে শ্রদ্ধা করেন, তার গুণাবলী পছন্দ করেন তাহলে সহজে তারা অন্য ধরনের কাজ কিংবা অফিসে কম সময় দেয়া বা কাজে মনোনিবেশ না করা জাতীয় কাজগুলো সাধারণত করেন না। কিন্তু বসরা তাদের সহকর্মীদের ধমকাধমকি করেন, নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠার কথা নিজেই প্রচার করা শুরু করলে তার ফল হয় উল্টো। এটি যদি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাহলে তো কথাই নেই। কারণ এখান থেকেই, শিশুরা, শিক্ষার্থীরা আদব কায়দা আচার আচরণ শিখবেন, শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষক কিংবা অধ্যক্ষের কাছে শিখবেন।
কিন্তু কি হয়েছে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে? বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার জোড়গাছ ইউনিয়নের হলিদাবগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তার সহকর্মীদের, বিশেষ করে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন সেটি জেনে আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা! দৈনিক আমাদের বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানলাম তিনি তার নারী সহকর্মীদের বলে থাকেন, ‘আমার স্কুলে চাকরি করতে হলে মনে করতে হবে তোমাদের স্বামী দুইটা। একটা বাড়িতে আছে আর একটা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কারণ আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে আমার সকল কথাই শুনতে হবে।’
প্রধান শিক্ষকের মুখে এ কেমন কথা! সব ধরনের নীতি, আদর্শ ও নিয়ম-কানুনের বাইরের কথা!
একজন প্রধান শিক্ষকের এ ধরনের কথা জেনে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাওয়ার উপক্রম! এ ধরনের প্রধান শিক্ষকদের অন্যান্য অফিসের বসদের মতো নিজস্ব অনেক দুর্বলতা রয়েছে যেগুলো ঢাকার এক ধরনের অপচেষ্টা মাত্র।
দৈনিক আমাদের বার্তায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, অমানবিকতা ও অশ্লীল কথাবর্তার অভিযোগ দিন দিন জোরালো হচেছ। এগুলোর মধ্যে আছে স্লিপ ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ, প্রশংসাপত্র দেয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন, বিজয় দিবসসহ অন্য দিবসগুলোর নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন, বিজয় দিবসসহ অন্য দিবসগুলোর নামে বরাদ্দকৃত অর্থ, পুরনো ভবনের লোহার অ্যাংগেল বিক্রির অর্থ, গত দুই বছরে আন্ত:ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও জাতীয় শিক্ষা পদকের বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ, সততা স্টোরের নামে দোকান দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার ব্যবসা ইত্যাদি।
ওই প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বিদ্যালয়টির অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও এলাকাবাসী। ইতোমধ্যে চাপের মুখে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলপনা খাতুন পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসে। ওই শিক্ষকের এমন অন্যায় আচরণের বিচার চেয়ে ইতোমধ্যেই পাঁচ শিক্ষক লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে।
শিক্ষা বিভাগ নিয়ে অনিয়ম ও অসন্তোষের শেষ নেই। তার ওপর মাঝে মাঝেই এ ধরনের ঘটনা ‘মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো মনে হয়’। শিক্ষা বিভাগ বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন শিক্ষকদের আচার আচরণের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে এবং করা উচিত। আমরা তো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়কে সমাজের অন্য কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করতে পারি না, করা কোনোভাবে উচিতও নয়।
এসব ঘটনাবলীর বিষয়ে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টার আবু সাঈদ মো: শফিউল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর অনেকটাই আমি জানি। শিক্ষিকাদের প্রতি অশ্লীল কথাবার্তার বিষয়টি সঠিক।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকতা এনায়েতুর রশীদ বলেন, বিভিন্ন সময় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মৌখিক অভিযোগ পাওয়া যাচেছ। বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক