ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ শিক্ষার্থী ভর্তি, মূল্যায়ন পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, শিক্ষার্থীদের দরিদ্র তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ বাণিজ্যসহ অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ বছরে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বরিশাল নগরীর এ আর এস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন। কিনেছেন একাধিক জমি, গড়েছেন বহুতল ভবন।
শিক্ষকের এমন কর্মকাণ্ডে হতবাক অভিবাবকসহ সচেতন মহল। তারা বলছেন, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি অনিয়ম দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তাহলে তার কাছ থেকে আগামী প্রজন্ম কী শিখবে?
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে এ আর এস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটিতে শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতা রয়েছে ১ হাজার ১০০ জনের। তার বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে ১ হাজার ৮০০ জন। ফলে শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানায়, একটা বেঞ্চে চারজন বসা অনেক কষ্টের। এভাবে বাধ্য হয়ে প্রতিদিন ক্লাস করতে হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অভিযোগ করে বলেন, প্রতি মাসে মূল্যায়ন পরীক্ষার নামে ১৫০ টাকা করে নেয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। কিন্তু নামমাত্র পরীক্ষা নিয়ে এসব টাকা তারা আত্মসাৎ করছেন। টাকা দিতে একদিন দেরি হলে প্রধান শিক্ষক অভিভাবকদের ডেকে পাঠান।
অভিভাবক মতিউর রহমান মিঠু বলেন, প্রতি মাসে পরীক্ষার নামে ১৮০০ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা করে কয়েক লাখ টাকা তোলা হয়। আদতে এ পরীক্ষা কোনো কাজেই আসে না শিক্ষার্থীদের। এছাড়া প্রধান শিক্ষক দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের দরিদ্র তহবিলের টাকাও নামে বেনামে আত্মসাৎ করেছেন। শিক্ষার্থীদের দরিদ্র তহবিলের যে তালিকা রয়েছে তাতে শিক্ষার্থীদের নাম, বাবার নাম ঠিক থাকলেও ভুয়া মোবাইল নম্বর দিয়ে এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর সরকারি তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকা আসে দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের দরিদ্র তহবিলের জন্য। সেই টাকা মাত্র ১৫ জন শিক্ষার্থীকে ৫ হাজার করে ৭৫ হাজার দেওয়ার তালিকা তৈরি করে বাকি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন প্রধান শিক্ষক। অভিভাবকদের হাতে যার প্রমাণ রয়েছে। এমনকি সেই তালিকার অধিকাংশ নম্বরই ভুয়া ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের। যাদের টাকা দিয়ে প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন হাত করে রাখতেন।
আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নান্টু সিকদার বলেন, এই স্কুলের যে কমিটি রয়েছে তা প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের মনগড়া পছন্দের লোকদের দিয়ে করা। যারা এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। তাদের হাত করে সম্প্রতি স্কুলে ৩ জন অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়ে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া এ বছরের দুই মাস বাকি থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাপ দিয়ে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বেতন এরইমধ্যে নিয়ে নিয়েছেন। একজন শিক্ষক যদি এভাবে অনিয়ম দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাৎ করেন তাহলে আগামী প্রজন্ম তার কাছ থেকে কী শিখবে!
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আনোয়ার হোসেন বরিশাল নগরীর সরদার পাড়ায় ৫ শতাংশ জমি, লাকুটিয়া বাবুর বাড়ি সংলগ্ন ১ তলা ভবনসহ ৬০ শতাংশ জমি, তার পাশেই আরও দুইটি ধানি জমি, নগরীর প্রবেশদ্বার গড়িয়ার পাড়ে ৩তলা ভবনসহ ১০ শতাংশ জমি ও রুপাতলী আদর্শ সড়কে ৪ শতাংশ জমিসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
লাকুটিয়া বাবুর বাড়ির পাশে ৬০ শতাংশ জমির একাধিক ওয়ারিশ থাকলেও তিনি একজনের কাছ থেকে ক্রয় করে অন্য ওয়ারিশদের প্রভাব খাটিয়ে বঞ্চিত করেছেন।
ওয়ারিশদের একজন বলেন, জমি ক্রয়ের বিষয়ে মাস্টার আমাদের কিছুই জানাননি। পরবর্তীতে সেই জমিতে থাকা একতলা দালানটি দখলে নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। এখন প্রতি মাসে এসে সেই ভাড়া নিয়ে চলে যান।
লাকুটিয়া এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম বলেন, এই এলাকায় তিনি কয়েকটি জমি ক্রয় করেছেন। শুনেছি আনোয়ার হোসেন একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তার কোনো ব্যবসা বাণিজ্য না থাকলেও শুধু শিক্ষকতা করে কীভাবে এতো সম্পদ গড়েছেন জানি না।
এ ব্যাপারে এ আর এস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ভালো চলছে দেখে একটি মহল তার পেছনে লেগে এসব ছড়াচ্ছে।
অর্থ আত্মসাৎ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব খরচ লেখা রয়েছে। কিন্তু দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি।
ভুয়া মোবাইল নম্বর দিয়ে নামে বেনামে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, দু’একটি ভুল হতেই পারে। তবে টাকা স্কুলের হেড ক্লার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।
হেড ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সব টাকাই প্রধান শিক্ষক নিজ হাতে বিতরণ করেন। তার কোনো হিসাব আমাদের হাতে নেই।
একাধিক জমি ও বহুতল ভবনের বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, কিছু জমি অনেক আগেই কেনা, আর কিছু জমি লোন নিয়ে কেনা হয়েছে। এছাড়া অনেক আগে কোচিং সেন্টার চালিয়ে টাকা ইনকাম করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের উপ-পরিচালক মাহবুবা হোসেন বলেন, একজন প্রধান শিক্ষকের ওপর একটি স্কুলের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। সেখানে সে যদি তার কাজের ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।