সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের একটি মিডটার্ম পরীক্ষায় ক্লাসে পড়ানোর বিষয়ের উপর শিক্ষার্থীদের তিনটি প্রশ্ন তৈরি করতে বলা হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিজেদের তৈরি করা প্রশ্ন থেকেই একটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে বলা হয়।
দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে এ বিষয়ক রিপোর্টটি দেখে থমকে যাই। পরদিন দেখি, দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তায় আরো পরিশীলিত আকারে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনাই চোখে পড়েছে। গতানুগতিক প্রশ্নধারার বাইরে এই উদ্যোগ নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
বিশ্ববিদ্যালটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন অ্যান্ড হিউম্যানিট্রিয়ান ল ইন ইসলাম’ কোর্সের প্রথম মিডটামের্র প্রশ্ন ছিল এটি। প্রশ্নের বিষয় ছিলো ’ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস’। প্রশ্নপত্রে বলা হয়- ‘মনে কর, তুমি জবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৪২০৬ নম্বর কোর্সের কোর্স শিক্ষক। ক্লাসে পড়ানো বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে তুমি নিজেই প্রশ্নপত্রের ন্যায় তিনটি প্রশ্ন তৈরি করো। তোমার তৈরিকৃত প্রশ্নগুলোর যে কোন একটির উত্তর দাও।’
চমৎকার প্রশ্ন! এ ধরনের প্রশ্ন তৈরি করতে অতিরিক্ত অর্থ, একট্রা মিটিং বা আয়োজনের দরকার নেই। একজন শিক্ষক এ ধরনের কাজ সহজেই করতে পারেন। আমরা কোন কিছু করার আগে মহাআয়োজন না করে যেনো পারিনা। অর্থাৎ সব জায়গাতেই ’খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’! প্রশ্নকারী শিক্ষক সেখানে দেখিয়ে দিয়েছেন, সৃজনশীল কিছু করার জন্য এতো বাজনা বাজানোর প্রয়োজন নেই।
ওই শিক্ষককে আন্তরিক ধন্যবাদ।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্রটি ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সাধুবাদ জানিয়েছেন। এ ধরনের প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন বিষয় চিন্তা করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলেও মনে করেন শিক্ষার্থীরা। হাসনাত নামের একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, এমন প্রশ্ন অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। আমরাও এমন টপিকের উপর অ্যাসাইনমেন্ট করেছি। গতানুগতকি চিন্তাধারার বাইরে শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ হয়।
ধন্যবাদ শিক্ষার্থীদের, বিষয়টির মর্ম বুঝার জন্য। না বুঝলে হয়তো ট্রাডিশনের বাইরে প্রশ্ন করায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই রাস্তায় ভাঙচুর শুরু হয়ে যেতো।
আমরা দেখে আসছি, বোর্ড পরীক্ষায় যুগ যুগ ধরে একই ধরনের, একই মেজাজের প্রশ্ন আসে, সেখানে নতুনত্বের ছিটেফোটা নেই। যদিও পরিবর্তন আনার জন্য কতো মিটিং, কতো সিটিং হয়। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ হয়। তারপর বলা হয়- এটি হলো সৃজনশীল প্রশ্ন, ওটি যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন ইত্যাদি। কিন্তু, কোনোটাই বাস্তবের ধারেকাছে থাকে না। এর অন্যতম কারণ হলো- যারা এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, এ ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করেন তাদেরকে ওইসব সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় কোথাও ডাকা হ য়না। ডাকা হয় অমুক সরকারি কলেজের বা সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষককে বা তমুক লোককে যার দহরম মহরম আছে নেতাদের সঙ্গে। ফলে চিন্তাভাবনায় কোনো নতুনত্ব আসে না।
বহু বছর যাবত বহুবার লিখেছি, ছোটখাট দু একটি সেমিনারেও বলেছি যে, প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করা, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বানানার প্রচেষ্টায় এতো মহাআয়োজনের কিছু নেই। ধীরে ধীরে নতুনত্ব আনা যায়। উদাহরণ হিসেবে অনেক জায়গায় লিখেছি, সারা জীবনই আমরা দেখি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে শুধু প্রশ্ন আসে এবং তা একেবারে ধরাবাধা, গৎবাঁধা। এর বাইরে কেউ যেতে চাননা। বিষয়টি আমি একবার এনসিটিবির এক সভায়ও বলেছিলাম, যেখানে দেশের শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেভাবে কেউ সাড়া দেননি। আমি বলেছিলাম, দুএক জায়গায় শির্ক্ষাথীদের প্রশ্ন তৈরি করতে দিতে হবে, যাতে ওই বিষয়টি তারা ভালভাবে ধারণা নিতে পেরেছেন কিনা তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী প্রশ্নবোধক বাক্য (বাংলা ও ইংরেজিতে) তৈরি করতে পারেন কিনা সেটির পরীক্ষাও হয়ে যাবে। তাদের আলাদাভাবে প্রশ্নবোধক বাক্য তৈরি করার কৌশল শেখানো হয়। কিন্তু এভাবে কনটেস্ট থেকে করা হলে সেটি হবে মৌলিক শিক্ষা, সেটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। জবির যে শিক্ষক এটি চালু করলেন তাকে আবারও ধন্যবাদ। অন্যান্য বিভাগের এবং দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও একটু আলাদা, গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে প্রশ্ন তৈরি করলে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করবেন এবং তাদের সৃজনশীলতা, স্বকীয়তা প্রকাশ পাবে, এটিই প্রকৃত পরীক্ষা। দেশের শিক্ষাবোর্ডগুলো পাবলিক পরীক্ষার জন্যও এমনটি করতে পারে, করা উচিতও। পরীক্ষা মানে শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর পারা নয়। অ্যাসেসমেন্ট হচেছ একজন শিক্ষার্থীর বিষয়জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন, দৃষ্টিভঙ্গি, বুঝতে পারার ক্ষমতা, নিজের মতামত যৌক্তিভাবে উপস্থাপন করা এবং একটি বিষয়কে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা ইত্যাদি যাচাই করা। সেটি শুধু প্রশ্ন দিয়ে উত্তর নিয়ে বিচার করা যায় না।
এই কোর্সের শিক্ষক বলেছন, ‘গৎবাঁধা নিয়মের প্রশ্নে সাধারণত সৃজনশীলতার অভাব থাকে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যাযের প্রশ্নের মান কিছুটা ইউনিক হবে, এটাই স্বাভাবিক। যদিও অনেক ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে দিন দিন নতুন কিছু শেখার আগ্রহ হারিয়ে যাচেছ। পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও যেনো শিক্ষার্থীরা ভিন্নভাবে চিন্তা করেন ও তাদের মাঝে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে-এমন চিন্তা থেকেই প্রশ্নটি করা। এতে শিক্ষার্থীরা বিগত দিনের প্রশ্নমুখী না হয়ে বইমুখী হবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো এমনই হবেন! এমন সৃজনশীলতার জন্য জবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের কোর্স শিক্ষক ড. আবু তৈয়ব মো. নাজমুছ ছাকিব ভূঁইয়াকে নিরন্তর শুভেচছা।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক