শিক্ষকদের আন্দোলনে কখন কে ঘরে থাকেন, কে বাইরে থাকেন, তা বড় কথা নয়। কে কোন মতের বা পথের তাও বড় কথা নয়। যদিও এই বিভক্তি শিক্ষকদের দাবি আদায়ের অন্তরায়। বিভিন্ন কারণে অতীতেও সব শিক্ষক সবসময় রাস্তায় আসেননি বা আসতে পারেননি। এর কারণগুলো কম বেশি সবারই জানা। বিশেষ করে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছে এই কারণগুলো স্পষ্ট। এগুলো ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেকেরই সমালোচনা করতে হবে, মূল বক্তব্য আড়ালে চলে যাবে, তাই এখন তা করতে চাচ্ছি না।
মূল কথা হচ্ছে, শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত! বিশেষ করে আমরা বেসরকারি শিক্ষকরা সর্বাধিক বৈষম্যের শিকার। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, বদলি, পদোন্নতি, প্রারম্ভিক বেতন, কল্যাণ তহবিল, অবসর ভাতা, পেনশন সুবিধা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকরা চরমভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, ক্ষুব্ধ! এ ব্যাপারে কারোই দ্বিমত নেই; সে যেকোনো দলের সমর্থকই হোন না কেন। সবারই পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে! যাদের বাড়তি আয়ের পথ নেই, ভিন্ন উদ্দেশ নেই, তাদের পিছু হটার বা আপোষ করার উপায় নেই। তাই ডাক পেলেই সমর্থন দেয়, সাড়া দেয়, সামনে আসতে চায়, আসে, আসতে না পেরে অনুতপ্ত হয়, বিবেকের তাড়নায় ভোগে!
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের বা সরকারি দলের যারা প্রকাশ্য সমর্থক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ছিলেন এবং এখনো আছেন তারাও এই দাবিগুলোর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেননি, করেন না। দাবি আদায়ের জন্য তারা রাস্তায় আসেননি বা আসতে পারেননি বলে নিশ্চিত বিবেকের তাড়নায় ভুগেছেন এবং এখনও ভুগছেন! হয়তো কৌশলগত কারণে একেক সময় একেক জন মুখ খোলেন না, রাস্তায় আসেন না, মিছিল করেন না; কিন্তু তাদেরও প্রাণের দাবি-শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা হোক; তা জাতীয়করণ বা সরকারিকরণ যেভাবেই বলা-করা হোক না কেন।
প্রতিটি বিবেকবান মানুষ এ বিষয়ে একমত। কেননা, শিক্ষকদের ক্ষুধার্ত রেখে, অসচ্ছল রেখে, অনিরাপদ রেখে, অসম্মানিত রেখে, দুঃখকষ্টে রেখে কোন দেশ-জাতি উন্নতি করতে পারে নি, পারে না, পারবে না। এই বাস্তব অবস্থাটি যত দ্রুত আমাদের সরকার বুঝবে, অনুধাবন করবে এবং শিক্ষক তথা শিক্ষার মানোন্নয়নে সক্রিয় হবে ততোই মঙ্গলজনক।
বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষকরা যে জীবন মানোন্ননের লক্ষ্য জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন, এখানে যাতে কোনো বৈষম্য না থাকে সেটি গবেষণার বিষয়-এজন্য একটি কমিটি করে গবেষণা করে দেখার জন্য তাদের দায়িত্ব দেয়া হবে। আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট আর্থিক বিষয়টি গবেষণা করে দেখার জন্য আরেকটি কমিটি গঠন করে দেয়া হবে; তারা দেখবে এতে আমাদের আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী কতদূর আগানো সম্ভব বা কতদ্রুত এটি আমরা দিতে পারব।
এ কথা সঠিক যে, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারি না করে সবদিক বিবেচনা করে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে নিরপেক্ষভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়াই উত্তম। তবে এটি শুরু করার জন্য অধিক সময়ক্ষেপণ কাম্য নয়। গবেষণা ও পরিকল্পনা সম্পন্ন করতে হবে দ্রুত। তা না হলে আরও বেড়ে যাবে শিক্ষকদের ক্ষোভ!
বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রশ্ন এলেই যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় বার বার। এর জন্য নিশ্চয়ই আমরা বেসরকারি শিক্ষকরা দায়ী নই। বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম থাকায় যুগ যুগ ধরেই এখানে অধিক যোগ্যরা আসেননি। সে দিকে খেয়াল না করে, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করে, অধিক যোগ্যদের আকৃষ্ট না করে, বলা হয়েছে- যার নাই কোন গতি সে করবে পন্ডিতি! আমরা আগেও ভাবিনি, এখনো ভাবছি না যে, সব পেশার তুলনায় শিক্ষক পদের যোগ্যতা ও বেতন-ভাতা হওয়া উচিত সর্বোচ্চ। যাতে শিক্ষক হতে আসেন সর্বাধিক যোগ্যরা। সব স্তরের সব ধরনের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও সম্মান সর্বাধিক নিশ্চিত করতে যতো বিলম্ব হবে ততোই তুলনামূলক কম যোগ্যরা শিক্ষক হয়ে একেকজন কমপক্ষে ত্রিশ বছর পর্যন্ত কম যোগ্য নাগরিক তৈরি করতে থাকবেন। এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ অত্যাবশ্যক। তাই এখনই বৃদ্ধি করতে হবে বিদ্যমান বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা। পাঠদানে নিবেদিত করার জন্য নিশ্চিত করতে হবে তাদের জীবন মানের উন্নয়ন। নিরসন করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য। সেই সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে জাতীয়করণ বা সরকারিকরণ প্রক্রিয়া।
লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।