আজ ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক অদিবাসী দিবস।১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ^ আদিবাসী দিবসটি পালনে ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। আন্তর্জাতিক দিবসটি বিশে^র ৯০টি দেশের ৩৭০বিলিয়ন আদিবাসীরা প্রতিবছর পালন করে থাকেন। জাতিসংঘ অবশ্য ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দকে আদিবাসী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। প্রতিবছর সারা বিশে^র ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। তবে সংবিধান অনুযায়ী আমাদের দেশে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী শব্দ ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার আলোচনাই এই প্রবন্ধের মূখ্য বিষয়।
নিজস্ব ভাষায় পড়ার সুযোগ পেলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। কারণ, তারা এটা খুব ভালো করে আয়ত্ত করতে পারে। এটি মানব শিশুর একটি সহজাত প্রবৃত্তি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষায় দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি-এই পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের কার্যক্রম শুরু করে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজেদের ভাষায় পড়াশোনা করবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। তৃতীয় শ্রেণি থেকে তাদেরকে বাংলা শেখানো হবে। শিশুদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদানের জন্য বাংলা শিখন-শেখানোর উপকরণের আদলে প্রণয়ন করা হয় ৮ ধরনের শিখণ-শেখানোর উপকরণ। এই উপকরণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে--মাতৃভাষার বই, ছড়ায় ছড়ায় বর্ণ শেখা, বর্ণ লেখার অনুশীলনী খাতা- এসো লিখতে শিখি, বর্ণ ও সংখ্যা ফ্ল্যাশ কার্ড, ফ্লিপ চার্ট, ১০টি গল্প বইয়ের প্যাকেজ, শিক্ষক নির্দেশিকা ইত্যাদি। স্ব স্ব নৃগোষ্ঠীর সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের উপাদান নিয়ে ছড়া, কবিতা, গল্প সংযোজন করা হয়েছে উপকরণগুলোতে।
বইয়ে ছবির মাধ্যমে বর্ণমালা শেখানো, গণনা শেখার ধারনা, সাধারণ জ্ঞান (চিহ্নের মাধ্যমে হাসাপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চেনানো), পারিপার্শ্বি^ক পরিবেশ ও পরিস্থিতি যুক্ত করা হয়েছে। উপকরণগুলোর অধিকাংশই নিজ নিজ মাতৃভাষায় রচিত। শুধু শিক্ষক সহায়িকার নির্দেশনাগুলোতে বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে। ১০টি গল্পের বইয়ের প্যাকেজের মধ্যে চারটি বই বাংলা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। বাকি ছয়টি যার যার সমাজ জীবনে প্রচলিত শিক্ষামূলক গলপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সরকারের এই মহতী উদ্যেগকে আমরা সবাই স্বাগত জানাই কিন্তু বহুদিরেন পুঞ্জীভূত সমস্যা কিছুটা সংকটে ফেলে দিয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। শিক্ষকদের কাছে এটি মোটামুটি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ, অনেক শিক্ষকই নিজ নিজ ভাষায় লিখতে ও পড়তে জানেন না। তারা তাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন কিন্তু লিখতে ও পড়তে পারেন না, তাদের লেখাপড়া পার হয়েছে বাংলা ভাষা শিখে। সে জন্য তাদের নিজেদেরও নিজ নিজ ভাষায় পড়া ও লেখার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অনেক স্কুলে আবার রয়েছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই মাতৃভাষা ব্যবহারকারী শিক্ষকের সংখ্যার স্বল্পতা। কোন কোন বিদ্যালয়ে দুইজনের বেশি শিক্ষক নেই। যারা মাতৃভাষায় শেখাতে পারেন। অথচ শিক্ষার্থী আছে একশরও বেশি। শিক্ষকদের মতো মারমা ভাষায় পড়ালে শিশুরা বুঝতে পারে তাড়াতাড়ি। যেহেতু, তাদের নিজস্ব ভাষা। বাংলা ভাষায় পড়ানোর পর তাদের আবার মারমা ভাষায় বুঝাতে হয়।
শিক্ষক স্বল্পতার কারণে যদি এক রুমে দুই শ্রেণির শিক্ষার্থী বসালে অন্য এক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা হা করে বসে থাকে। অর্থাৎ যদি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক রুমে বসানো হয় এবং সেখানে যদি পঞ্চম শ্রেণির বই পড়ানো হয় তাহলে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বসে থাকে। শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সেটিতেও ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয়ভাবে জাবারাং যে প্রশিক্ষণ দেয় তাতে পুরো উদ্দেশ্য সফল হয় না।
তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় যখন পড়ানো হয় সেই কারণে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ বাড়ে। বাংলা ভাষার চেয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষার আগ্রহ তাদের বেশি। ইউকে এইডের আর্থিক সহায়তায় ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন -এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে খাগড়াছড়ির স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাবারাং কল্যাণ সমিতি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার তিন উপজেলায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ মাতৃভাষা শিক্ষায় সহায়তা দিয়ে আসছে। এমএজএফ কারিকুলাম বইয়ের পাশাপাশি সহায়ক বই হিসেবে তিনটি ভাষায় গল্প, ছড়ার বই প্রকাশ করে বিতরণ করেছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, যে ভাষার যে শিক্ষক, পড়ানোর জন্য তাকেই দরকার। তাদের প্রশিক্ষিতও হতে হবে। প্রশিক্ষণ যদি হয় এবং সেটি যদি পিটিআই-র মাধ্যমে করানো হয়। তাহলে এই মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম আলোর মুখ দেখবে। এখন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় পড়ানো হয়। আমরা মনে করি, এই ব্যবস্থা যেনো।’
মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য সরকার ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যবই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে থেকে সেটির বাস্তবায়ন শুরু হয় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি এবং গারো। এই পাঁচ ভাষায় পাঠ্যবই বিতরণের মাধ্যমে। এ বছর (২০২৩) জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রায় পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৯৭ হাজার ৫৯৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে দুই লাখ ৩০ হাজার ১৩০টি বই বিতরণ করেছে। এই বই পড়ানোর দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ শিক্ষকই এসব ভাষায় লিখতে-পড়তে জানেন না। শুধু কথা বলতে পারেন। দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ৪৫টি। এদের অনেকের নিজস্ব ভাষার লিপি ও বর্ণমালা রয়েছে। তবে শিক্ষা চর্চার সুযোগ না থাকায় এসব ভাষার বেশিরভাগই হারিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস সিলেট অঞ্চলে। এই বিভাগে প্রায় ৩৭টি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে চা বাগানেই রয়েছে ২৫-২৬টি নৃগোষ্ঠী। তবে সিলেটের ৩৭ নৃগোষ্ঠীর মধ্যে এখন পর্যন্ত দু-তিনটি ছাড়া আর কারোরই সরকারিভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ মেলেনি। মণিপুরী ল্যাংগুয়েজ সেন্টার নামে কমলগঞ্জে মণিপুরী ভাষা শিক্ষার তিনটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকলেও সরকারিভাবে বেশিরভাগ নৃগোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু কেবল বই বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং পাঠদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। কারণ, একই ক্লাসে বহুভাষায় কথা বলা শিক্ষার্থীদের পাঠদান পদ্ধতি প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির চেয়ে আলাদা। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রুং বলেন, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করার অধিকার আছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ, জাতিসংঘের সদস্য। এই স্কুলগুলোতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।’
বর্তমান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাদের নিজস্ব ভাষায় শেখার ব্যবস্থা করেছে। এটি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এখন নির্দিষ্ট কোনো নৃগোষ্ঠীর শিক্ষকরা যদি তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় লেখাতে ও পড়াতে না পারেন সেটি একটি গভীর সমস্যা। এখানে সরকারের পক্ষে হঠাৎ করে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব নয়। আর একটি হচ্ছে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সবার ভাষায় বই তৈরি করাও কতোটা বাস্তবসম্মত সেটিও আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, সব নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা নেই। যে পাঁচটি ভাষায় বই তৈরি করা হয়েছে, ওই ভাষার লোকসংখ্যাই বেশি। এটিতো একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত। তবে এই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে।
বিশে^র প্রতিটি দেশেই রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক। একটি দেশের উন্নয়নে তাদের অবদান ও অর্জনকে স্বীকৃতি দিতেই জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেব ঘোষণা করেছে। ২০০৭-এ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেও ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয় সেখানে আদিবাসীদের বারটি ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বিশেষ করে ভূমি সংক্রান্ত অধিকারগুলোই ছিলো মুখ্য। ঘোষণাপত্রে -ভূমি ও ভূখণ্ডের অধিকার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি ও ভূ-খণ্ডের ওপর সামরিক কার্যক্রম বন্ধের অধিকার, তাদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাবার অধিকার এবং তাদের সম্মতি ছাড়া যেসব ভূমি, ভূখণ্ড এবং সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে সেগুলো পুনরুদ্ধার ও ফেরত পাবার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ টিম, দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা