সুচনা যদি ভালো না হয় শেষটাও ভালো হওয়ার কথা নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে আমরা বলি শিক্ষা জীবনের ভিত্তি। ভিত্তি যদি মজবুত না হয় তাহলে যেকোনো সামান্য প্রতিকূল পরিবেশে সহজে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর সেটাই স্বাভাবিক। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা জাতিসংঘ ঘোষিত আমাদের অঙ্গীকার। প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী, মানসম্মত, করতে প্রাক-প্রাথমিকের কোনো বিকল্প নেই।
প্রাথমিক শিক্ষার ওপরেই নির্ভর করে দেশের আগামীর কারিগর নির্মাণ ও স্বপ্ন। আর স্বপ্ন বিনির্মাণে সহযোগিতা করে পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান। কারণ, এখানেই সুন্দর আগামীর, সুশৃঙ্খল আগামীর বীজ বপন করা হয়।
আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী শিশুদের (৫+ বছর) বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, নান্দনিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও ভাষা বিষয়ক তথা সার্বিক বিকাশে সহায়তা দিয়ে আজীবন শিখনের ভিত্তি রচনা করা এবং প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে তাদের সানন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিষেক ঘটানো।
ক. আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে বিভিন্ন খেলা ও কাজের মাধ্যমে শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা খ. শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা গ. শিশুর সৌন্দর্য, নান্দনিকতাবোধ ও সুকুমারবৃত্তি বিকাশে সহায়তা করা ঘ. শিশুকে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করা; ঙ. নিজস্ব সাংস্কৃতিক আচার, কৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি এর চর্চায় উৎসাহিত করা চ. নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতি বিকাশে সহায়তা করা ছ. শিশুর স্থূল ও সূক্ষ্মপেশী তথা চলনশক্তির বিকাশে সহায়তা করা জ. স্বাস্থ্য সচেতনতা ও নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা করা ঝ. শিশুর ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা ঞ. প্রারম্ভিক গাণিতিক ধারণা, যৌক্তিক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করা ট. পরিবেশের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কারণ ও ফলাফল সম্পর্ক অনুধাবনে সহায়তা করা ঠ. শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত কল্পনা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশে সহায়তা করা ড. শিশুর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বিকাশে সহায়তা করা এবং নিজের কাজ নিজে করতে উদ্বুদ্ধ করা ঢ. আবেগ বুঝতে পারা ও তার যথাযথ প্রকাশে সহায়তা করা ণ. শিশুকে পারস্পরিক সমঝোতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভাগাভাগি করতে সহায়তা ও উদ্বুদ্ধ করা ত. শিশুকে প্রশ্ন করতে আগ্রহী করে তোলা ও মতামত প্রকাশে উৎসাহিত করা এবং থ. শিশুকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা।
শিশু তখনই সবচেয়ে বেশি শেখে যখন সে আগ্রহ নিয়ে কোনো কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। পরিবারে, বিদ্যালয়ে ও সমাজে বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের শিখনের মূল ভিত্তি। কোনো ধারণা বা তথ্য যখন শিশুর পূর্ববর্তী অর্জিত জ্ঞান বা ধারণার ভিত্তিতে তার কাছে অর্থপূর্ণ মনে হয়, তখনই শিশু তার শিখনের পরবর্তী ধাপে প্রবেশ করে। শিশুরা সমন্বিতভাবে শেখে এবং তারা তাদের শিখনকে কোনো বিষয় বা শাখায় বিভক্ত করে না। যে কারণে খেলা হচ্ছে শিশুর শেখার অন্যতম মাধ্যম। শিশুরা বিভিন্নভাবে শেখে। প্রত্যেক শিশুরই শেখার ধরনের একটা নিজস্বতা থাকে। তবে কোনো শিশুই একভাবে শেখে না।
শিশুরা সাধারণত যেভাবে শেখে তা হলো; দেখে, গন্ধ নিয়ে, কল্পনা করে, তুলনা করে, অংশগ্রহণ করে, দলে কাজ করে, গল্পের মাধ্যমে, বই পড়ে, পর্যবেক্ষণ করে; শুনে; অনুভব করে, একাকী চিন্তা করে, নির্দেশনা থেকে, গান করে, অনুসন্ধান করে;নাচের মাধ্যমে, শুনে, অনুকরণ করে, স্বাদ নিয়ে, উপলব্ধি করে, প্রশ্ন করে, নাড়াচাড়া করে, ছড়ার মাধ্যমে; বার বার চেষ্টা করে, অভিনয়ের মাধ্যমে এবং উপলব্ধি করে।
এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, আমি ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্র্যাকে যোগদান করি। ব্র্যাক তখন সারাদেশে চল্লিশ হাজারের মতো গভর্নমেন্ট পার্টনারশীপ প্রোগ্রাম (জিপিপি) নামে একটা প্রোগ্রাম পরিচালনা করত। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো, ৪+ সকল শিশুকে এক বছর প্রি-প্রাইমারি শ্রেণিতে পড়ানোর পরে ১০০% শিশুকে সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তিকৃত শিশুকে পরবর্তি পাঁচ বছর (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) ফলোআপ করতে হবে।
প্রথম দিন আমি অফিসের কাছাকাছি একটা স্কুলে তিন ঘন্টা ছিলাম। আমি অবাক হয়েছিলাম যে কিভাবে একজন শিক্ষক ৩০ জন শিক্ষার্থী কে ম্যানেজ করে। অবশ্য শিক্ষিকার একটা সহায়িকা ছিল যেটা তিনি ফলো করতেন। বলা বাহুল্য যে এই ৩০ জন শিক্ষার্থী কিন্তু হঠাৎ করে স্কুলে আসেনি বা হঠাৎ করে ভর্তি হয়েছে এমনটা না।
প্রতিবছর জুলাই থেকে জরিপ করা, অনেক গুলো ধাপ পার হয়ে ডিসেম্বর থেকে নার্সিং শুরু করা হতো। এই নার্সিং থেকে শিশু বাছাই করা হতো, সবশেষে ২৫ থেকে ৩০ জন শিশু নিয়ে প্রি-প্রাইমারী পরিচালনা করা। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে আগত শিশুকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে শিশুকে, সেই সাথে শিক্ষিকাকে ও অনেক বিড়ম্বনার মধ্যে কাজ করতে হতো। জাতীয় সংগীত, নাচ, গান, ছড়া, গল্প বলা ও খেলার মাধ্যমে শুভ সূচনা করে অক্ষর, গণিত, সমাজ ও মুল্যবোধ ও চর্চার মাধ্যমে শেষ হতো প্রাথমিক বিদ্যালয় পাঠের প্রারম্ভিকতা। এই পথ চলায় এমন হয়েছে যে, কখনো শিশুরাও শ্রেণি পরিচালনা করছে। ভাবা যায় একজন শিশু ৩০ জনের শ্রেণি পরিচালনা করছে!
এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করার জন্য বছরের শুরুতে ১ বার ৫ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং প্রতি মাসে ১ দিনের রিফ্রেশার্স পরিচালিত হতো।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২০২২ অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৬ টি, শিক্ষক/শিক্ষিকা সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জন। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য সৃজিত পদ সংখ্যা ৩৭ হাজার ৬৭২ টি, নিয়োগ পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৮৯৫ জন। হিসাব অনুযায়ী ৩০ হাজার ৬৭১ টি স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পরিচালনার কোনো শিক্ষক/শিক্ষিকা নেই। তাহলে ৩০ হাজার ৬৭১ টি স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চলে না আর চললেও কিভাবে সম্ভব?
আমার যদি ভুল না হয় তাহলে বলতে পারি উপজেলা সদর বা সদরের কাছাকাছি বাদে গ্রামের অধিকাংশ স্কুলে গড়ে ৪ জন করে শিক্ষক/শিক্ষিকা আছেন, একজন প্রধান শিক্ষককে স্কুলের কাজে প্রায়শই শিক্ষা অফিসে আসতে হয়। বাকি ৩ জন কিভাবে প্রি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রম চলমান রাখবেন ! শিক্ষাক্রম যদিও ২ শিফটে হয় তাও তো সম্ভব নয়। এখানেও প্রি-প্রাইমারি শ্রেণি উপেক্ষিত রয়ে গেলো। অবাক হবার কিছু নেই যে খোদ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর -র ওয়েবসাইটেও প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি নিয়ে তেমন বলার মতো কিছু নাই যা আমাদের জন্য অনেক হতাশার। শিক্ষক সহায়িকা বলে যে অ্যাপস আছে সেখানে প্রি-প্রাইমারি বলা অপসনে কোনো কাজ করে না।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সীমিত পরিসরে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ১ বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না, শ্রেণিকক্ষ স্বল্পতা, শিক্ষক ঘাটতির কারণে সব স্কুলে এখনও প্রি-প্রাইমারি শ্রেণি পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
গত কয়েক দিন আগে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে মোবাইলে কল করলেন, উভয়ের কুশল বিনিময়ের পরে বললেন, ভাই আপনাদের প্রি-প্রাইমারি সেকশনটা আমাদের স্কুলের রুমে চালানো যায় না। আমি বললাম ,আপনি চাইলে সম্ভব। উনি বললেন ঠিক আছে ,তাহলে ব্যবস্থা করেন।
উনার মতো অনেক শিক্ষক আছেন যারা চান, সরকারি বা বে-সরকারি যেভাবে হোক প্রি-প্রাইমারি শ্রেণিটা পরিচালনা হোক। অনেক সময় দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু সম্পত্তি আছে, সেখান থেকে বিদ্যালয় মাসিক কিছু আয়ও হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই আয় দিয়ে স্থানীয় একজন শিক্ষক নিয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পরিচালনা করছে এমন ধারণা বিরল। তবে স্কুলের স্বার্থে এমন মহৎ কাজ এসএমসি করতে পারে।
প্রাইভেট পড়ানোটাকে আমরা কেউ সমর্থন করি না। তার মানে এই না যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এটা চলেনা। শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার দোহাই দিয়ে হরহামেশা চলছে এ কাজ। চলছে চলবে তাতে বাধা নেই ,তবে একজন প্যারা শিক্ষক যদি নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে কি খুব ভুল হবে। তিনি সকালে প্রি-প্রাইমারি ক্লাস নিবেন, পরে ৫ম শ্রেণির শিশুদের পড়াবেন। শিশু শ্রেণি সংক্রান্ত সব কাজ তিনি করবেন। যদি কেউ উদ্যোগ নেয়, খারাপ হবে না।
কিন্তু বাস্তবতা বলে অন্য কথা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিটা সরকারি কিন্তু যুগোপযোগী, গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে তারা অনেক দুরে আছে। তাই ভাবতে হবে প্রাক- প্রাথমিক শ্রেণি টা পুরোটাই রাষ্ট্র পরিচালনা না করে সরকারি বে-সরকারি ব্যবস্থাকে সমন্বয় করে পরিচালনা করলে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে আমরা ব্রতী হতে পারি।
লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় টেকনিক্যাল অফিসার, বরগুনা