এ নিবন্ধ লিখতে গিয়ে গানের একটি লাইন মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। লাইনটি হলো-‘তুমি আজ কত দূরে’। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টও আজ প্রাথমিক শিক্ষকদের মাঝ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির একজন রাজপথের কর্মী ও সাধারণ সম্পাদক, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, ২০০৮ থেকে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্বরত থেকে একবুক জ্বালা নিয়ে নয়, বরং সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে এ লেখা। এ কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক শিক্ষক তথা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অর্জন। Government primary school teacher’s welfare trust ordinance ১৯৮৫ মোতাবেক সরকারি অনুদান ও এককালীন ২০ টাকা এবং বার্ষিক চাঁদা ২ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট’। তৎকালীন সব শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য হয়েছেন। ১৯৮৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের চাঁদা প্রদান, সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি, নিজ বা পরিবারের চিকিৎসা, মারা গেলে শিক্ষকদের মরদেহ দাফনের খরচ, প্রাকৃতিক বা আকস্মিক বিপদে আর্থিক সহযোগিতা ছিলো নিয়মিত। কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব থাকাকালীন, ট্রাস্টের যাবতীয় সংবাদ প্রকাশ হতো প্রিন্ট মিডিয়ায়। উৎসবমুখর প্রাণের কল্যাণ ট্রাস্ট আজ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে বন্দি। দীর্ঘসময় থেকে সম্পর্কহীন এ কল্যাণ ট্রাস্ট শিক্ষকদের কল্যাণে গতি আনতে পারছে না, নানা চালেঞ্জের কারণে। কল্যাণ ট্রাস্টে প্রাথমিক শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। বর্তমানে কল্যাণ ট্রাস্টের সঙ্গে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষকের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য ছাড়া কোনো শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের সহযোগিতা বা সুযোগ-সুবিধা পান না।
এ আইনের অধীনে সুবিধা লাভের পূর্বশর্ত
১. এ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেনো, কোনো শিক্ষক তার নিয়োগের ৬ মাসের মধ্যে প্রাথমিক চাঁদা হিসাবে ট্রাস্ট কর্তৃক নির্ধারিত এককালীন অর্থ এবং নির্ধারিত হারে বার্ষিক চাঁদা ট্রাস্টে জমা না করলে তিনি এ আইনের অধীনে কোনো সুবিধা লাভের অধিকারী হবেন না।
২. উপধারা ১-এর অধীনে নির্ধারিত চাঁদার অর্থ ট্রাস্ট কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিশোধ করতে হবে।
চাঁদা পরিশোধের পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বর্তমানে প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষক চাঁদা পরিশোধ করে সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারেননি। এ ব্যর্থতা ট্রাস্টি বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এরশাদ সরকার আমলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় গভর্নমেন্ট প্রাইমারি স্কুল টিচার্স ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অর্ডিন্যান্স মোতাবেক ট্রাস্ট গঠিত হয়েছিলো। তখন সারা দেশে ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র নেতৃত্বে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৯৮ শতাংশ শিক্ষক একই পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ ছিলো। ঐক্যবদ্ধ থাকায়, সমিতির নেতৃত্বে শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করে কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদা আদায়, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা শিক্ষকরা সহজে পেয়ে যেতেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য প্রতিনিধি প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের হলেও শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা কম ছিলো। এর ফলে শিক্ষকদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট ইতিবাচক কাজ করতে সক্ষম হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের জনগোষ্ঠী হলো, প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষককে সম্পৃক্ত না করে কতিপয় নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা যদি তাদের মনগড়া শিক্ষক দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের কল্যাণ করতে চান, তা সম্ভব হবে না। বর্তমানে প্রয়োজন কল্যাণ ট্রাস্টকে প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছাকাছি এনে তাদের কল্যাণকে সমৃদ্ধ করা। এ প্রেক্ষাপটে কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করছি : বর্তমানে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষকই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য হয়নি। এজন্য তাদের ছয় মাস সময় দিয়ে সদস্য হওয়ার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে সদস্য হওয়ার জন্য বার্ষিক চাঁদা ২০০ টাকার নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘসময় কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম শিক্ষক সমাজের গণ্ডির বাইরে থাকায়, তারা এ সুযোগ সম্পর্কে অবহিত নন। কল্যাণ ট্রাস্টের বর্তমান জমাকৃত অর্থ মিলে প্রায় ৪০ কোটি টাকা রয়েছে। বর্তমানে সব শিক্ষককে সদস্য করা হলে আরো বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর জমা হবে। সব শিক্ষককে স্বেচ্ছায় কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় আনার অভিপ্রায়ে বার্ষিক চাঁদা ৫০ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করছি।
এ বিশাল কর্মকাণ্ডকে উপজেলা/থানা পর্যায়ের সব শিক্ষকের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে তিন বছরের জন্য ওই প্রতিনিধি নির্বাচিত করা। যারা তৃণমূল পর্যায়ে কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবে সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। উপজেলা পর্যায়ে ট্রাস্টের প্রতিনিধি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য শিক্ষা অফিসের অভ্যন্তরে বা নিকটবর্তী স্কুলে ট্রাস্টের অফিস প্রয়োজন।
বর্তমান কল্যাণ ট্রাস্টের আইনে বলা হয়েছে, প্রতি বিভাগে একজন শিক্ষক প্রতিনিধি, যা সরকার মনোনীত। প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্টে সরকার মনোনীত প্রতিনিধি কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। উপজেলা বা থানায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটে বিভাগীয় পর্যায়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করা প্রয়োজন। এতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি কল্যাণ ট্রাস্ট সব শিক্ষকের কাছে তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অন্যতম অর্জন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট। এ ট্রাস্ট সব শিক্ষকের কল্যাণে গঠিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৫ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষকরা তাদের সুখ-দুঃখের কথা সহজে সদস্য সচিবকে বলতে পারতেন। সদস্য সচিব হিসেবে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডে তা আবেদন বা ফাইলে নোটের মাধ্যমে উত্থাপন করতেন। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮নং আইনের ধারায় ট্রাস্টি বোর্ড গঠনে ২ উপধারা মোতাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) দায়িত্ব পালন করবেন। ট্রাস্টি বোর্ডের উপপরিচালক (প্রশাসন) তার দায়িত্বের বাইরে প্রাথমিক শিক্ষকদের বিশাল জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আন্তরিক হলেও তা দেখভাল করতে গেলে সব ধরনের কল্যাণকর কাজই বিঘ্নিত হবে। কারণ সদস্যসচিব পদটি সার্বক্ষণিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই কল্যাণ ট্রাস্টকে গতিশীল করার লক্ষ্যে সাবেক অবসরপ্রাপ্ত ট্রাস্টি বোর্ডের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে থানা/উপজেলা প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্বাচিত সদস্যসচিব করা হলে কল্যাণ ট্রাস্ট শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে এবং অধিকতর গতিশীল হবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন) তেমন সম্পৃক্ত আছে বলে দৃশ্যমান নয়। এক্ষেত্রে ওই সদস্য পদের পরিবর্তে উপপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা বিভাগকে সদস্য হিসেবে ট্রাস্টি বোর্ডে গ্রহণ করলে অধিকতর কার্যকর হবে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব থাকাকালীন প্রতিটি উপজেলায় শিক্ষক প্রতিনিধি মনোনয়ন দেয়া হয়েছিলো। তৎকালীন মহাপরিচালক খন্দকার আসাদুজ্জামানের নির্দেশ মোতাবেক সদস্য সচিব হিসেবে আমাকে আহ্বায়ক করে ট্রাস্টি বোর্ডের শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য মরহুম ফিরোজ উদ্দিন ও মনোয়ারা বেগমকে সদস্য করে কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা উপকমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটির প্রস্তাবনা ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। ‘কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা’ ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাভ করে। অথচ দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় এ নিয়োগবিধি কার্যকর হয়নি। অনুমোদনকৃত চাকরিবিধি বাস্তবায়ন না করা দুঃখজনক। ৯৫ ভাগ প্রাথমিক শিক্ষককে ট্রাস্টের সুবিধার পাশাপাশি ট্রাস্টের কর্মচারীদের নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন না করে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অমানবিক।
এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক শিক্ষকদের গড়া। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ট্রাস্টের অধ্যাদেশ মোতাবেক চাঁদা প্রদানকারী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য। অথচ ২০২৩ এর অধ্যাদেশে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ট্রাস্টকে সমৃদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত প্রবীণ শিক্ষক ও কর্মচারীরা। প্রাথমিক শিক্ষক ভবন, ব্যাংকে গচ্ছিত প্রায় অর্ধকোটি টাকা, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা, ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে আন্দোলন করে প্রাথমিক শিক্ষা বেসরকারিকরণ থেকে সরকারিকরণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের আন্দোলন, ২০০৫ খাতের শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ অসংখ্য অর্জন ও আন্দোলনের ইতিহাস বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির স্মৃতিবিজড়িত সংগ্রামী ঐতিহ্য। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট, মিরপুরে অবস্থিত প্রাথমিক শিক্ষক ভবনসহ ব্যাংকে গচ্ছিত প্রায় অর্ধকোটি টাকা প্রাথমিক শিক্ষকদের ইতিবাচক কল্যাণে দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অর্জিত সম্পদ হোক সব প্রাথমিক শিক্ষকের। সব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বাইরে থাকুক শিক্ষকদের অর্জন ও কল্যাণ। এ প্রেক্ষাপটে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০২৩ সংশোধন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের কল্যাণে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে বিনীত নিবেদন জানাচ্ছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ