প্রাথমিক স্তরে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। সোমবার এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানান।
বিবৃতিদাতারা হলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাশেদা কে চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক এম এম আকাশসহ ৩০জন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, এটা সর্বজন বিদিত যে, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৬,১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত শিক্ষাক্রম সংস্কারসহ বর্তমান সরকার কিছু শিক্ষাবান্ধব কৌশল ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু দৃশ্যমান সাফল্য এনে দিয়েছে। এই অর্জনগুলো এখন সারা বিশ্বেও স্বীকৃত।
এক সময় প্রচলিত ব্যবস্থায় মেধাবৃত্তি প্রদানের উপায় হিসেবে বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে সেটি বাদ দিয়ে শুরু হয় ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি)’ পরীক্ষা। কিন্তু আমরা জানি যে, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি ও নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে তিন বছর ধরে পিইসি পরীক্ষা হচ্ছে না।
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম, যে শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ অবস্থায় বছরের একেবারে শেষ সময়ে আকস্মিকভাবেই পুরানো ব্যবস্থার মতো ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’ নেয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষায় পরিবর্তনের যে ইতিবাচক ধারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে এভাবে হুট করে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস। এছাড়াও নতুন শিক্ষাক্রমে যেখানে সব শিক্ষার্থীর মেধার সম্পূর্ণ বিকাশের নানা দিককে উৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে একটি বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করলে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী।
এতে বলা হয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর লক্ষ্যে বর্তমানে প্রচলিত সনাতন শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং পরীক্ষা-নির্ভর, সনদসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু শুধুমাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণা আমাদের হতাশ করেছে। শিক্ষা নিয়ে প্রায়শ এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে থাকে, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
তাছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রতি বছর 'সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ' প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যেভাবে আমাদের বিভিন্ন স্তরের ও নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা, এমন কি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বাছাই করা হয়ে থাকে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সব শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের এরকম একটি সুন্দর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন শুধুমাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য হঠাৎ করে ‘বৃত্তি পরীক্ষা’ চালু করা হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। তদুপরি, এই পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ইতোপূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে অভিভাবকদের বাড়তি খরচেরও সম্মুখীন হতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।
বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করে বলা হয়, নীতি নির্ধারকরা আকস্মিকভাবে ঘোষিত এবং জাতীয়ভাবে পরিচালিত 'প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা'র মতো পাবলিক পরীক্ষার (High Stake Exam) পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর দিক-নির্দেশনার আলোকে সব শিক্ষার্থীর জন্য উপজেলাভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে মেধাবৃত্তি প্রদানের বিষয়টিকে বিবেচনা করবেন। এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের পথে এগিয়ে যাবে বলে আমরা মনে করি। যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নসহ ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ এবং ঝউএ৪-এর লক্ষ্য “সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা”র অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে, বেগবান হবে জাতীয় সম্মিলিত প্রয়াস- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।