প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির চ্যালেঞ্জ - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির চ্যালেঞ্জ

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

কওমি মাদরাসা ব্যতিরেকে প্রাথমিক, উচ্চবিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেনসহ প্রায় সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে করোনা পরবর্তীতে শিক্ষার্থী ভর্তি হ্রাস পেয়েছে। তবে কওমি মাদ্রাসা খোলা থাকার ফলে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছেন। বর্তমানে শিক্ষাবান্ধব সরকার বিনামূল্যে নতুন বই সরবরাহ করেছে। বিদ্যালয় ভবন সুসজ্জিত করেছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক উচ্চশিক্ষিত মাস্টার্স, অনার্সসহ শিশু শিক্ষায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এতদসত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে কতিপয় চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করছি।

শিক্ষক সঙ্কট 

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ৩২ হাজার ৫৭৭টি শূন্য পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় প্রায় ৩ বছরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে সময়ক্ষেপণ হতে যাচ্ছে। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকের শূন্য পদের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। প্রাথমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া এ সীমাহীন সময়ক্ষেপণে আগামী প্রজন্মের পাঠদানের যে বিশাল ক্ষতিসাধন হচ্ছে, তা সচিব, মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধি হচ্ছে বলে দৃশ্যমান নয়। সহকারী শিক্ষক পদ প্রত্যাশীদের আন্দোলনের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব শূন্য পদ পূরণের নির্দেশনা দিয়েছেন।

অপরদিকে প্রধানশিক্ষকের শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। 

প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অবহেলায় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে এভাবে চলে আসছে। শিক্ষক সঙ্কটের কারণে দরিদ্র অভিভাবকরা উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে আগ্রহী হচ্ছেন না। প্রবাদ আছে “পাগলেও তাদের বুঝ বোঝে”। দরিদ্র হলেও ডিজিটাল যুগে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের প্রতি সচেতন। এর ফলে শিশু শিক্ষায় কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভর্তি প্রক্রিয়া 

প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারি-বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ১৬ নভেম্বর থেকে ১ম শ্রেণিসহ ভর্তির কার্যক্রম শুরু করেছে। অথচ নির্বাক হয়ে বসে আছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। কিন্ডারগার্টেনসহ সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি যখন সম্পন্ন  হবে, তখন জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী খুঁজে বেড়াবে। তখন তৃণমুলের কর্মকর্তারাসহ সবাই শিক্ষার্থী তেমন ভর্তি না হওয়ার অভিযোগে শিক্ষকদের দিকে আঙুল প্রদর্শন করতে কার্পণ্য করবেন না। কিন্তু, শিক্ষার্থী সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে তাদের যে করণীয় আছে, তা তাদের উপলব্ধিতে আসছে না। 

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অবশ্যই নভেম্বর থেকে ব্যানার, ফেস্টুন টানিয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষকের। এ ব্যাপারে মন্ত্রনালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তেমন কোন দায় আছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে। 

অভিন্ন ভর্তি প্রক্রিয়া, বই, ছুটি, কর্মঘণ্টা ও মূল্যায়ন 

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বিগত সময়ের পাঠদান ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, শিশু শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি বই, ভাল পাসের জন্য প্রয়োজন। অমনোবিজ্ঞানসম্মত মাত্রাতিরিক্ত বই ও মুখস্থ করে ভাল নম্বর প্রাপ্তি মেধার বিকাশ নয়। এতে মেধার বিনাশ হয়ে থাকে। এ ধারণা আজও তাদের মাঝে জাগ্রত হয়নি।  আজও তাদের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা । পরীক্ষা না থাকলে বা পড়ার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ভেস্তে যাবে। আমাদের শিশুদের প্রয়োজন বেশি বেশি জ্ঞান। তার মানে বড় বড় পাস নয়। শিক্ষকরা শিশুর সব শব্দ, বাক্যের বা অধ্যায়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান দেবেন এবং মূল্যায়ন করে অন্য পাঠে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। দুর্বল শিক্ষার্থীদের অধিক পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলবেন। 

শিক্ষক ও কর্মকর্তার মানসিকতা পরিবর্তন 

শিক্ষক ও শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা ছিল হৃদয়জুড়ে। সে ভালবাসার প্রতিদানে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। নচেৎ বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের মতো এমপিওভুক্তির দাবিতে রাজপথে চিল্লাচিল্লি করে হয়তো ক্লান্ত দেহ-মন নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হতো। শিশু শিক্ষার প্রত্যাশা ছিল জাতীয়করণ। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ও শিক্ষাবান্ধব সরকারের  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আন্দোলন বা সংগ্রাম করতে হয়নি। এখন প্রধান শিক্ষকরা ২য় শ্রেণি ও সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণি। স্বাধীনতা ৫০ বছর পরও এ মর্যাদা জাতির জন্য গৌরবের নয়। সব শিক্ষকের ১ম শ্রেণি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। সরকারিকরণের ফলে আজ সহকারী শিক্ষকরা তাদের ১০ম গ্রেডের জন্য মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পেরেছেন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার সফলতা কামনা করছি। প্রাথমিক শিক্ষকরা জাতির জনক ও তার কন্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিষ্পাপ শিশুদের শিক্ষাদান কাজে জড়িত। মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে তাদের অন্যতম ইবাদত শিক্ষাদান কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করা। বাংলাদেশে একমাত্র প্রাথমিক শিক্ষকরা লক্ষাধিক প্রতিযোগিতার মধ্যে নির্বাচিত উচ্চ শিক্ষিত। উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। এ গর্ব অনুধাবন করে দেশের আনাচে-কানাচে সব শিশুর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। কর্মকর্তাদের উপলব্ধি করতে হবে, তারা নিষ্পাপ শিশুদের শিক্ষার যথাযথভাবে পরিচালনা, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ দূরীকরণের মহাযজ্ঞের কর্মকর্তা। এতো কিছুর পরও প্রাথমিক শিক্ষক, কর্মকর্তাদের মাঝে প্রায় আহামরি মনোভাব। এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে সাহসিকতার সাথে উপলব্ধি করতে হবে যে, আমরা সর্বাধিক ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মন্ত্রণালয়ের। আমাদের সামনের সারিতে থেকে দেশ ও জনগনের কল্যাণ এগিয়ে যেতে হবে। এ পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থী সঙ্কট দূরীকরণে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি।

যেহেতু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শিক্ষার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ পরিবেশ বিদ্যমান। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার। বয়স, রুচি, মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদানের লক্ষ্যে সরকারি, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিশু শিক্ষায় তেমন কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এ প্রেক্ষাপটে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বিলুপ্ত করার প্রত্যাশা করছি। জাতীয় শিক্ষানীতির সফল বাস্তবায়নে ও এদেশের তৃণমূলের সাধারণ মানুষের অবৈতনিক শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় দ্রুত ৮ম শ্রেণির পর্যন্ত খোলার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানাচ্ছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ খালির বিষয়টি জিরো টলারেন্স নামিয়ে আনতে হবে। শিক্ষকসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি, চরম শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষক পদ শূন্য রাখা মারাত্মক অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মাঝে শিশু শিক্ষার শিক্ষার্থী সঙ্কট দূরীকরণসহ মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে সুষ্ঠু পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। 

লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ  ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।

 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039839744567871