প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরীক্ষণ বিদ্যালয় এক নয়! - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরীক্ষণ বিদ্যালয় এক নয়!

আলমগীর হোসেন, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান অর্জন এবং বৈষম্য বিরোধী একটি মানবিক জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন একটি প্রশিক্ষিত শিক্ষক সমাজ। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে বর্তমান ৬৭ টি পিটিআই একযোগে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যেখানে রয়েছে মৌলিক ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভিত্তি  মজবুত করার সুবর্ণ সুযোগ। 

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের দেশে দুই ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু ছিলো, যার একটি হলো গুরু প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা জিটি স্কুল এবং অপরটি হল মোয়াল্লেম প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়, যাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিলো খুবই নিম্নমানের। প্রাথমিক  শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আরো উন্নত এবং প্রায়োগিক করার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আকরাম খাঁ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের আলোকে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় পিটিআই বা প্রাইমারী টিটার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট  স্থাপন করা হয়,এবং শিক্ষকদের ভর্তির যোগ্যতা নূন্যতম মাধ্যমিক করা হয়। মাওলানা আকরাম খাঁ শিক্ষা কমিটির রিপোর্টে গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্য দেয়া হয় যে, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে পুঁথিগত জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্ব বেশি না দিয়ে ব্যবহারিক কাজের সমন্বয়ে একে কার্যকরি করতে হবে। সুপারিশে আরো বলা হয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে শিশুর মনমানসিকতা যাচাই করার একটি বিশেষ স্হান থাকবে। যার আলোকে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এর সঙ্গে একটি করে পরীক্ষণ বিদ্যালয় গড়ে উঠে, যেটি মূলত প্রশিক্ষণের ল্যাবরেটরি হিসেবে গণ্য হবে।

মাওলানা আকরাম খাঁ শিক্ষা কমিটির এই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশে  প্রায় ৪৭ টি পিটিআই এবং সংযুক্ত পরীক্ষণ বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ড. কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ও প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য ফুটে ওঠে, ফলে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় এক নতুন মোড় নেয় এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালিত হতে থাকে।  পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলো সরাসরি এর প্রধান সুপারিনটেনডেন্ট এর নেতৃত্বে পিটিআই এর নিজস্ব পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, সুপারিনটেনডেন্ট এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সমমর্যাদা  ও সমগ্রেডের অফিসার যার একজন সংশ্লিষ্ট জেলার শিক্ষা প্রশাসন এবং অন্যজন জেলার প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকেন। 

পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলো মূলত প্রশিক্ষণ ল্যাবরেটরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও দীর্ঘদিন শিক্ষক শূন্যতা এবং প্রশিক্ষণবিহীন প্রাথমিক শিক্ষক দ্বারা এর কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় অনেকেই সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলোকে একই মনে করে গুলিয়ে ফেলেন যা পরীক্ষণ বিদ্যালয়  তথা পিটিআইয়ের কার্যপরিধির জন্য হুমকি স্বরূপ। 

প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরীক্ষণ বিদ্যালয় এর মধ্যে পার্থক্য 

প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো জেলার এমন একটি বিদ্যালয় যা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্য পুস্তকের মধ্যে জ্ঞানচর্চা সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে পরীক্ষণ বিদ্যালয় প্রত্যেক জেলায় অবস্থিত পিটিআই সংলগ্ন একটি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় যা সরকার নির্ধারিত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক এর পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যেকোনো গবেষণা ও পরীক্ষামূলক জ্ঞানের প্রয়োগ করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অনুসরণীয় আদর্শ হলো পরীক্ষণ বিদ্যালয়, অন্যদিকে পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলো একটি ল্যাবরেটরি বা গবেষণার স্হান। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের নিয়োগকালীন কাম্য যোগ্যতা যেকোনো বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, যেখানে শিক্ষা বিষয়ক বা প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কোনো যোগ্যতা থাকেনা অন্যদিকে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগকালীনকাম্য যোগ্যতা শিক্ষা বিষয়ক স্নাতক ডিগ্রি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কর্তৃক সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কেবলমাত্র শিক্ষার্থী পঠন পাঠনের মধ্যেই নিজের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ , অন্যদিকে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নন ক্যাডার অফিসার হিসেবে  নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে সরাসরি শিক্ষার্থী পঠন পাঠনের পাশাপাশি আগত প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনেও সহায়তা করে থাকেন। 

নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন পরিকল্পনা কিংবা পাইলটিং বা যেকোনো শিক্ষানীতি সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্ত ও গবেষণা প্রয়োগের বিশেষায়িত বিদ্যালয় হলো এই পরীক্ষণ বিদ্যালয়।
পরীক্ষণ বিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন শিক্ষক শূন্য থাকার কারণে তার কার্যক্রমের মূল স্পিড থেকে  খানিকটা সরে গেলেও গত ৭ জুলাই নতুন শিক্ষক যোগদানের মধ্য দিয়ে পুনরায় পূর্ণ উদ্যোগে কার্যক্রম করে। বর্তমান পিটিআই সমূহে প্রাথমিক শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণ হিসেবে বেসিক ট্রেনিং ফর প্রাইমারি টিচার্স (বিটিপিটি)কোর্স চালু আছে যেখানে সরাসরি পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জড়িত নাই, তার কারণ হলো পরীক্ষণ বিদ্যালয় এর এই শিক্ষক-শূন্যতা। তবে যেহেতু এখন প্রতিটি পিটিআইতে পরীক্ষণ বিদ্যালয় এর শিক্ষকরা কর্মরত আছেন তাই অনতিবিলম্বে তাদের বিটিপিটি প্রশিক্ষণে জড়িত করা যেতে পারে। পিটিআই সমূহের সূচনা লগ্ন থেকেই ইন্সট্রাক্টর এবং পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়োগকালীন একই যোগ্যতা এবং একই গ্রেডে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্সট্রাক্টরদের দাবির প্রেক্ষিতে এক বিশেষ আদেশে তাদের গ্রেড আপডেট করে দশম থেকে নবম গ্রেড ঘোষণা করা হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেড উন্নয়ন করা হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু প্রতিটি সেক্টরে সংস্কার করার সংকল্প গ্রহণ করেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগেও আমরা আশা করবো যুগান্তকারী এবং বৈষম্য বিরোধী সংস্কার করবেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইন্সট্রাকটরদের ন্যায় এক গ্রেড আপগ্রেড করে অর্থাৎ বিদ্যমান ১০ম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেড প্রদান করে পুরনো সম্মান ও মর্যাদা  ফিরিয়ে দিবেন এই আহ্বান জানাচ্ছি ।

লেখক: পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক 

দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৮ লাখ - dainik shiksha দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৮ লাখ ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি যৌক্তিক’ - dainik shiksha ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি যৌক্তিক’ পাঠ্যবই থেকে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতা বাদ দেয়া কামাল চৌধুরী গ্রেফতার - dainik shiksha পাঠ্যবই থেকে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতা বাদ দেয়া কামাল চৌধুরী গ্রেফতার ঢাবি ছাত্রশিবিরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ - dainik shiksha ঢাবি ছাত্রশিবিরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ হাত-পা বেঁধে ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রকে হ*ত্যার অভিযোগ - dainik shiksha হাত-পা বেঁধে ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রকে হ*ত্যার অভিযোগ শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটি, মামলা - dainik shiksha শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটি, মামলা এলএলবি শেষ পর্বের ফরম পূরণ শুরু ৬ অক্টোবর - dainik shiksha এলএলবি শেষ পর্বের ফরম পূরণ শুরু ৬ অক্টোবর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041370391845703