নৈতিক স্খলনের অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পরেও কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে যোগদান করতে দেয়নি। সিণ্ডিকেটের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে প্রায় দেড় মাস পর বুধবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে কাজে যোগ দিতে যান রেজিস্টার। তার কাগজপত্র গ্রহণ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক বলেছেন, বিষয়টি আইগতভাবে মোকাবেলা করা হবে।
এদিকে রেজিস্ট্রারের যোগদানের চেষ্টার ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়া বলেন, সমিতির আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্তে দোষী হওয়ায় সিন্ডিকেট কমিটি রেজিস্ট্রারকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু রেজিস্ট্রার সিন্ডিকেটের আদেশ মানতে চাচ্ছেন না। এই ঘটনায় শিক্ষক সমিতিসহ অন্যান্যরা ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে রেজিস্ট্রার তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট দাবি করে বলছেন, তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তাই তিনি আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আদালতের আদেশ তার পক্ষে রয়েছে।
মনিরুলের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন ছাড়াও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা, নিয়োগ বাণিজ্য, প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় সিন্ডিকেট তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে।
রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করার পর থেকে মনিরুল ইসলাম নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন।২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চাকরি প্রত্যাশী তরুণীর সাথে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ভিসির কাছে ওই ঘটনার বিচার চেয়ে একটি লিখিত আবেদন করেন। ভিসি ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট সভায় রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত করে এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয়। এরপর মনিরুল ইসলাম ছুটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন: ভিডিও কলে চাকরি প্রত্যাশী ছাত্রীর কাছে যৌন আবেদন
ঢাকা বোর্ডের মাসুদার `দুর্নীতি’ তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ
`মাসুদার স্বামী আবার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে!’
যৌন হয়রানি: শিক্ষা ক্যাডার সমিতির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রভাবিত করার অভিযোগ
গত ১৯ ডিসেম্বর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন ড. হাসিনুর রহমানকে রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ১৬ জানুয়ারি দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. হাসিনুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠি দেয়া হয় অভিযুক্ত রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামকে। চিঠিতে মনিরুল ইসলামকে নৈতিক স্খলনের দায়ে পদত্যাগ করতে বলা হয়। তা না হলে বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেখ আছে।
ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম। গত ২২ জানুয়ারি উচ্চা আদালতের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক-আল জলিলের দ্বৈত বেঞ্চ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কমিটির আদেশ স্থগিতের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের এই আদেশ নিয়ে মনিরুল ইসলাম কাজে যোগ দিতে গেলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনিরুলের দেওয়া উচ্চ আদালতের কাগজ গ্রহণ করেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মো. মনিরুল ইসলাম ঢাকার বেসরকারি (নন এমপিওভুক্ত) ক্যামব্রিয়ান কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। তঁর স্ত্রী মাসুদা বেগম ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থাকাকালে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে মনিরুলকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পাইয়ে দেন। নিয়ম অনুযায়ী কম পক্ষে দুই বছর ডেপুটি রেজিষ্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর রেজিস্ট্রার হওয়ার কথা। কিন্তু সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও তার সাবেক পিএস এ এস মাহমুদ এবং মনিরুলের স্ত্রীর পরিচিতির সূত্র ধরে প্রভাব খাটিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই রেজিস্ট্রার হন মনিরুল ইসলাম। মাঝখানে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মনিরূলকে ঢাকার ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার করা হয়। তবে, নানা কারণে তাকে আবার বরিশালেই যেতে হয়। মনিরুলের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ ও তদন্ত হলেও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ব্যানার ব্যাবহার করে প্রভাব খাটিয়ে তদন্তের ফল নিজের পক্ষে নিয়ে নেন। সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগসহ নানা অভিযোগে গত বছর তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একটি সূত্র জানান, অভিযুক্ত মনিরুলকে স্বপদে ফেরত নিতে তার স্ত্রী দৌড়ঝাপ শুরু করেন।
সিন্ডিকেট সভার আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্ত:
গতবছরের ১৭ নভেম্বর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৯তম সিন্ডিকেট সভার আলোচ্য বিষয় ছিল রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে করা তদন্ত প্রতিবেদন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সভায় রেজিস্ট্রার মনিরুলের নৈতিক স্খলন সংক্রান্ত অশালীন ভিডিও এবং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদন থেকে সিন্ডিকেট নিশ্চিত হয় রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এক নারীর সঙ্গে ভিডিও আলাপচারিতায় যৌন আবেদন প্রকাশ করে অনৈতিক কাজ করেছেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার এধরণের কাজ নৈতিক স্খলন প্রমাণ করে। এর আগেও একবার মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে সিণ্ডিকেট সভা রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার অংশ হিসেবে তাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
অভিযুক্ত রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম দৈনিক শিক্ষা ডটকমকে বলেছেন, আমাকে পদত্যাগ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল। আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছি। আদালত সিন্ডিকেটের ওই আদেশ স্থগিত করেছে। তাই আমি যোগদান করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভিসি আমাকে যোগদান করতে দেননি। বুধবার বিকেলে আমি আদালতের ওই আদেশ রেজিস্ট্রি ডাকযোগে ভিসির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এসএম ইমামুল হক দৈনিক শিক্ষা ডটকমকে বলেন, মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতি সিন্ডিকেট সভা তাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার জন্য নির্দেশ দেয়। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি। গতকাল বুধবার তিনি হাইকোর্টের একটি আদেশের কাগজ নিয়ে আসেন। ওই আদেশ ভ্যাকেট করার জন্য আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।