বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকলেও সাতক্ষীরা ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় তা ঠেকানো যাচ্ছে না। স্কুল বা কলেজে পড়ুয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রীদের গোপনে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। সোমবার ও শুক্রবার সপ্তাহের এ দুইদিন বাল্যবিয়ের আয়োজন করা হয়। তবে অন্যান্য দিনেও বাল্যবিয়ের আয়োজন হচ্ছে। তবে, বাল্যবিয়ে আয়োজনের খবর পেলেই মাঠে নামছে প্রশাসন।
গতকাল বৃহস্পতিবার একদিনেই তিনটি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় একটি এবং তালা উপজেলায় দুটি বাল্যবিয়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পল্লীতে একদিনে দুই কিশোরীর বাল্যবিয়ে বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ সময় এক কিশোরীর মাকে ৫ হাজার টাকা এবং বাল্যবিয়ে আয়োজনে সহযোগিতার জন্যে শেখ মো. কামাল উদ্দীন নামের আরেক ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন পৃথকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এ রায় ঘোষণা করেন।
তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, বৃহস্পতিবার তালা সদর ইউনিয়নের মুড়াকালিয়া গ্রামে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে আয়োজন চলছিলো। এ সময় মহিলা বিষয়ক অফিসের আবৃত্তি শিক্ষক আসাদুল ইসলাম ও ভিডব্লিউবি প্রশিক্ষক রাজিবুল ইসলাম সেখানে হাজির হন। রান্নার কাজও শেষ পর্যায়ে ছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন। প্রসিকিউশন দেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার। তালা থানার এসআই রাজিবের নেতৃত্ব পুলিশের একটি টিম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বাল্যবিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, মেয়ের মায়ের মুচলেকা গ্রহণসহ তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং বাল্যবিয়ের আয়োজনে সহযোগিতার জন্যে শেখ মো. কামাল উদ্দীন নামের আরেক ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত। পরবর্তীতে রান্না করা পাঁচ হাড়ি খাবার পার্শ্ববর্তী এতিমখানায় পাঠানো হয়।
এদিকে একইদিনে উপজেলার কুমিরা গ্রামে এক কিশোরীর বাল্যবিয়ে বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময় ওই কিশোরীর বাবা মুচলেকা দিয়েছেন। কুমিরা ইউনিয়ন কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সংগীত শিক্ষক শম্পা ভট্টাচার্য ও আবৃত্তি শিক্ষক আনিছা খাতুন ওই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিয়া শারমিন বিষয়টি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে নিশ্চিত করেছেন।
এর আগের দিন গত বুধবার তালায় দশম শ্রেণির ছাত্রীকে বিয়ে করায় বর সুমন মোড়ল রাসেলকে ১৫দিনের কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বর সুমন মোড়ল তালা উপজেলার ইসলামকাটী ইউনিয়নের উথালী গ্রামের বিল্লাল হোসেন মোড়লের ছেলে। এ সময় জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে আরো চারদিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন এ রায় ঘোষণা করেন।
তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, ২-৩ দিন আগে উপজেলার বারাত এলাকার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিয়ে করে সুমন মোড়ল রাসেল। বুধবার ছিল তাদের বাড়িতে বৌভাত অনুষ্ঠান।
সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর ইউনিয়নের বেড়বাড়ী এলাকায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলের বৌ'ভাত অনুষ্ঠান মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব ফাতেমা-তুজ-জোহরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ছেলের বাবাকে ৮ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে ১৫ দিনের জেল) করা হয়। সদর উপজেলার আলীপুর আজিজীয়া দাখিল মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই ছাত্রীকে তার বাবার মুচলেকা নিয়ে বাড়ি একই উপজেলা আলিপুর গ্রামে ফেরত পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত সম্প্রতি একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীব্যাপী বাল্যবিয়ে একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর সারাবিশ্বে ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের হার ৫২ শতাংশ। খুলনা বিভাগে বাল্য বিয়ের হার ৭১ শতাংশ ও সাতক্ষীরায় এই হার ৭২ শতাংশ। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর। যাদের প্রথম বাচ্চা জন্মদানের গড় বয়স ১৭ বছর। বিভিন্ন কারণে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এরমধ্যে অভিভাবকদে সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতা, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার ইত্যাদি দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।