সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষকরা। কারণ, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় জুলাই ২০২৪ থেকে যোগ দেয়া চাকুরেদের সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিদ্যমান পেনশনের বদলে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। সরকারের এ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিক্ষকরা জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আজকের মধ্যে ওই স্কিম বাতিল ও নিজেদের কিছু দাবি আদায় না হলে আগামীকাল থেকে সর্বাত্মক কর্মসূচিতে যাবেন তারা। শিক্ষকদের পাশাপাশি কর্মকর্তারা ও কর্মচারীরাও কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ ইস্যুতে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেছেন, সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। সার্বিকভাবে বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন বলে তিনি আশা করেন। অপরদিকে শিক্ষকরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পেনশন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বৈষম্যমূলক। অবিলম্বে এটি প্রত্যাহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন করা হোক।
তারা আরো বলছেন, এ প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হবেন। একই বেতন স্কেলের আওতাধীন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সরকারের ভিন্ন নীতি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের সম্মান করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে গেছেন। সেই শিক্ষকদের প্রদেয় সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হবে আর তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, এটিই আমাদের জন্য লজ্জার। ৩০ জুনের পর আমাদের যে নতুন সহকর্মীরা আসবেন তারা জানবেন তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় কেনো আসবেন?
ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমরা আমাদের জন্য কিছু করছি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য, মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় ধরে রাখার জন্য কাজ করছি।
তিনি বলেন, যে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। মেধাবীর এ পেশায় আসবেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহেদ রানা বলেন, হঠাৎ করে এমন প্রজ্ঞাপনের ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, অর্থ মন্ত্রণালয় পেনশন বিষয়ে দুটি বিজ্ঞাপন জারি করে। এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে আগামী ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকার পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করলো। একই দিন সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ১ জুলাইয়ের পর থেকে ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি বাধ্যতামূলক। বিদ্যমান প্রগতি, প্রবাস, সুরক্ষা ও সমতা- এই চার পেনশন কর্মসূচি ঐচ্ছিক হলেও নতুন স্কিম বাধ্যতামূলক।
‘প্রত্যয়’ স্কিমে চাঁদার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা--এ দুয়ের মধ্যে যেটি কম, সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা চাকরিজীবীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংস্থা দেবে। দুই অঙ্ক একত্রে চাকরিজীবীর পেনশন আইডির বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা করবে। যেদিন প্রতি মাসের বেতন দেয়া হয়, তার পরের কর্মদিবসের মধ্যেই কাজটি করতে হবে। এ জমা অর্থের পরিমাণ ও মেয়াদের ভিত্তিতে অবসরকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন ভোগ করবেন। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে যে প্রজ্ঞপন জারি করা হয়েছে তা প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে। যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে, সেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আর স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে যারা কোন আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠেছে। এর মধ্যে কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি রয়েছে। বাংলা একাডেমি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও এই তালিকায় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ১৪ লাখের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতে গত আগস্টে চালু করা হয় সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। তখন চার শ্রেণির মানুষের জন্য চারটি স্কিম চালু করা হয় এবং একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হয় , সুবিধামতো সময়ে সরকার আরো দুটি স্কিম চালু করে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসবে। সেই ধারাবাহিকতায় এই সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তে আসার আগে এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান পেনশন সুবিধা পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে। বর্তমানে বিভিন্ন কমিশন ও করপোরেশনে সরকারি কর্মচারীদের আদলেই পেনশন দেয়া হয়, যা এ ধরনের মোট প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশের বেশি নয়। এর বাইরে প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্যত তহবিলের মাধ্যমে অবসর সুবিধা দেয়া হয়। এ তহবিলে চাকরিজীবীরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দেন, আর সংস্থা দেয় ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অবসরের পর এ টাকা এবং এর বাইরে প্রতিবছর দুই মাসের মূল বেতনের সমান আনুতোষিক অর্থাৎ গ্রাচুইটি তারা পান। আবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্যত তহবিলও নেই। এ ক্ষেত্রে অবসরের পর চাকরিজীবীরা শুধু গ্রাচুইটি পেয়ে থাকেন। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটিকে একদিকে পজিটিভই বলা যায়। তবে, মানুষের একটি ভয় থেকে যায় যে, সরকারের অনেক মহতী উদ্যোগই নাগরিকদের সুবিধা দিতে পারেনা। অসাধু, লোভী এবং দেশপ্রেমহীন অনেক কর্মকর্তা ও পলিসি মেকারদের কারণে। অর্থ মন্ত্রণালয় এসব ক্ষেত্রে কতোটা সন্তোষজনক ও ভীতিহীন ব্যাখ্যা দিতে পারবে সেটি আমরা এখনো শুনিনি। আমাদের দাবি থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন যতোটুকু আছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করেন সেক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি না হয়। কারণ, এমনিতেই শিক্ষকতায় মেধাবীরা আসছেন না। তারা হয় সিভিল সার্ভিসে চলে যাচ্ছেন, না হয় বিদেশে। সবশেষ বিষয়টি হচ্ছে শিক্ষকদের যাতে অর্থ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তিত হতে না হয়। এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান তলানীতে গিয়ে পৌঁছেছে, তার মধ্যে যদি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতি ও আন্দোলন চলতে থাকে তাহলে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, সেটি জাতির জন্য মহাসংকট। বিষয়টি সবাইকে ভেবে দেখতে হবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক