বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষা ভাবনা - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষা ভাবনা

মো. আবু তাহের মিয়া, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

কথায় আছে হাঁড়ির সব ভাত টিপতে হয় না। এক ভাতে টিপ দিয়ে হাঁড়ির সব ভাতের খবর জানা যায়। তেমনি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের সম্মানের অবস্থা যাছাই করলেই সব জানা হয়ে যায়।  একদিকে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিস্তার ফারাক বৈষম্য বেড়েই চলছে, অন্যদিকে শিক্ষকদের চরম অবহেলা। এক কথায় শিক্ষা ব্যবস্থার হ-য-ব-র-ল আর শিক্ষকদের ওপর চলছে চরম নৈরাজ্য, নির্যাতন, হেনস্তা, পদত্যাগের হিড়িক। দেখার যেনো কেউ নেই, রাষ্ট্র সম্মান না দিলেও। সর্বশেষ জলন্ত প্রমাণ শিক্ষকদের যাথাযোগ্য সম্মান দিলেন এক ছাত্র। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেনের পদত্যাগ দাবি করে শিক্ষকের চেয়ারে বসে ছবি তোলেন তিনি। সেটি ফেসবুকে শেয়ার করেছে এক ছাত্র। তাও সে মেধাবী বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বাদশা আলমগীর বেঁচে থাকলে হয়তো প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসনের জন্য কি আফসোসই না করতেন! ছাত্রের এমন হীন কাণ্ডের দায় কার? শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, নাকি সমাজ ব্যবস্থা, না রাষ্ট্রে শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদা না দেয়া, নাকি দীর্ঘ দিনের সিস্টেমে ছাত্রের প্রধান শিক্ষক হওয়া। নাকি শিক্ষকরা ছাত্রদের সুশিক্ষা দিতে ব্যর্থ!

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। চালু হয়নি একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। আধুনিক বাস্তবভিত্তিক ও কর্মমুখী শিক্ষা। শিক্ষা কোনো শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একে সর্বজনীন করে দেয়া। শিক্ষা হবে গণমুখী, অভিন্ন ও সর্বজনীন। সবার জন্য শিক্ষা। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা আলোর মুখ দেখেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো জ্ঞানের বাগান। কোনো বাগান যেমনি এক জাতের ফুলের সমাহারে সজ্জিত হয় না, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নানা মত, বিশ্বাস, ও বিভিন্ন পথের মানুষের সমাহার থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।  শিক্ষার লক্ষ্যও তাই। পৃথিবী এগিয়ে চলছে, শুধু কি এগিয়ে, একেবারে রকেটের গতিতে ছুটে চলছে। আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কচ্ছপের গতিতেও এগিয়ে যাচ্ছে না, বরং উল্টো পথে হাঁটছে। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশিক্ষার লক্ষ্য থাকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য কি? পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিভক্ত ও মানহীন করা হয়েছে। শিক্ষার মান একেবারে তলানিতে। বৈষম্য নিয়ে আলোচনা এখন সর্বস্তরে দানা বেঁধে উঠছে। শিক্ষায় বৈষম্য কাম্য নয়।

শিক্ষার রূপান্তর বা শিক্ষার উন্নয়ন কে করবে, শিক্ষক না অন্য কেউ। শিক্ষার উন্নয়ন শিক্ষককে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর শ্লোগান ছিলো শিক্ষার রূপান্তর শিক্ষক দিয়ে শুরু। কিন্তু এটা ছিলো কথার কথা। শিক্ষকদের সেভাবে গড়ে তোলা যায়নি। শিক্ষকদের ডাল-ভাতের নিশ্চয়তাটুকু না করে কিভাবে শিক্ষক শিক্ষার রূপান্তর ঘটাবেন। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষকরা ১৩ হাজার টাকা বেতন পান। সে টাকায় কিভাবে  শিক্ষার রূপান্তর করবেন। জাতির মেরুদণ্ড তৈরির মূল উৎপাদক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা এ বাজেটে অনুপস্থিত। শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা না দিয়ে অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়েছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং শিক্ষা-পরিবেশের বিদ্যমানতা বিবেচনার বাইরে রেখে সঠিক এবং সফল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা সমস্যাকীর্ণ হয়। শিক্ষা কমিশন গঠন করে, শিক্ষা কমিটি করে, ম্যানেজিং কমিটি দিয়ে, শিক্ষা কর্মকর্তা দিয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম ও শিক্ষকদের চাওয়া-পাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। তবেই শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে।

মানুষ প্রতিনিয়ত শিখে, এক সময় মাইলের পর মাইল হেঁটে জ্ঞান অর্জন করেছে। এখন ঘরে বসেই ইউটিউব, গুগলে সার্চ দিলেই পৃথিবীর সমস্ত তথ্য বেরিয়ে আসে। সে যুগে শিক্ষক তার পাঠদান ও আচার-আচরণ দিয়েই সম্মানটুকু আদায় করে নিতে হয়। তাই কবি বলেছেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’/ ‘নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’,। কবি-সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটিতে কবির মনে হয়েছে এই গোটা পৃথিবী একটি পাঠশালা আর কবি সেখানে একজন ছাত্র।  যিনি দিন রাত ধরে এই বিশ্ব প্রকৃতির কাছ থেকে নতুন নতুন জিনিস শিখছেন । পিতা-মাতা যেমন আমাদের প্রথম শিক্ষক তেমনি প্রকৃতি থেকেও আমরা শিক্ষা পাই। একজন সফল মানুষের পিছনে শিক্ষক যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন তা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। একজন শিক্ষক শুধুমাত্র পুস্তক শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন তা নয়।  শিক্ষার্থীদের ভাল-মন্দ বিচার, দূর ভবিষ্যত লক্ষ্য মাত্রা স্থির করতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। 

শিক্ষক দিবসটি পৃথিবীর সকল শিক্ষকদের অবদান স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে  ইউনেস্কো মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালনের করা হয়। এর পর থেকেই ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে । এটি  দেশ বিদেশে ‘শিক্ষক’ পেশাজীবিদের  জন্য সেরা সম্মান। পরবর্তী প্রজন্মও যাতে কার্যকরী ও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে এই দিনটি পালন করে সেটাও উদ্দেশ্য। শিক্ষকদের প্রতি এক ধরনের ধোঁয়াটে সম্মান আমাদের সমাজের মানুষ দেখায় বটে। কিন্তু প্রায় সবাই ‘আহা বেচারা’ বলে মাস্টারদের প্রতি মনে মনে করুণাই পোষণ করে কেবল। অন্য চাকরি বা পেশার বদলে তাদের ছেলেটি শিক্ষক হোক, এ-রকম খুব কম মা-বাবাই চান। পরিবার পরিজন বা অন্য সব শুভানুধ্যায়ীদেরও একই মনোভাব। আপনি কি চান আপনার সন্তান বড় হয়ে শিক্ষক হোক? উত্তর নিশ্চয়ই সবার জানা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতাকে এখনো পেশা হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরি হয়ে উঠেনি। রাষ্ট্র এখনো শিক্ষকতাকে ‘ব্রত‘ হিসেবে দেখতে চায়। তাই রাষ্ট্রের দেয়া বাজেটে শিক্ষকতা পেশায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দেশে শিক্ষকের মর্যাদা নেই। রাষ্ট্র চায় শিক্ষকরা কোনোরকম খেয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে দায়িত্ব পালন করুক। বাংলাদেশের শিক্ষকরা তা করে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়। যা আমাদের দেশে নেই। চীনে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষককে ডক্টর উপাধিপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমান মর্যাদা দেয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষকদের উচ্চতর স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রধান করা হয়। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সহকারী শিক্ষক (বাংলা), তাড়ল উচ্চ বিদ্যালয়, দিরাই, সুনামগঞ্জ

বেতন ও বিবেকের স্বাধীনতায় পিছিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকরা - dainik shiksha বেতন ও বিবেকের স্বাধীনতায় পিছিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকরা দ্রুত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে - dainik shiksha দ্রুত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচি শুরু - dainik shiksha বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচি শুরু শিক্ষকদের কথার মূল্যায়ন: শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন সামাজিক চুক্তি - dainik shiksha শিক্ষকদের কথার মূল্যায়ন: শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন সামাজিক চুক্তি বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রত্যাশা - dainik shiksha বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রত্যাশা শিক্ষকের কণ্ঠস্বর হোক সামাজিক অঙ্গীকার - dainik shiksha শিক্ষকের কণ্ঠস্বর হোক সামাজিক অঙ্গীকার কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037229061126709