সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থী। অভিভাবকরা বলছেন, সরকারি বিদ্যালয়গুলোর তুলনায় বেসরকারি বিদ্যালয়ে পাঠদানের মান ভালো। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে তাদের। এ অবস্থায় উপজেলার কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে সামর্থ্যহীন অভিভাবকরা সন্তুষ্ট না হলেও সরকারি বিদ্যালয়েই সন্তানদের রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ পরিস্থিতির পেছনে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা একটি বড় কারণ। বিশেষ করে উপজেলার অর্ধেকেরও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষক নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকায় শিক্ষকসংকটের কোনো সমাধান হয়নি। প্রবাসীবহুল এ জেলায় শিক্ষকদের বিদেশ চলে যাওয়া ও চাকরি পরিবর্তনসহ নানা কারণে এ সংকট মিটছে না। চলতি দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা বাড়তি ক্লাস নিতে গেলে শিক্ষার মানে তার প্রভাব পড়ছে, অভিভাবকরাও আস্থা হারাচ্ছেন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে।
অভিভাবকদের মতে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় উপজেলার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মান ভালো। তাই সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে বিত্তবানরা তাদের সন্তানদের সেখানেই পাঠাচ্ছেন। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই, তারা বাধ্য হয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রাখছেন সন্তানদের। এখন কিন্ডারগার্টেনগুলোতে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও কমছে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৫০টি। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক আছেন ৭৭টিতে। বাকি ৭৩টি বিদ্যালয়ে এ পদটি শূন্য। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষকের পদ রয়েছে ৯৬৫টি। এর মধ্যে শূন্য পদের সংখ্যা ৫০টি।
সরেজমিন কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনেরও কম। যদিও নিয়ম অনুযায়ী কোথাও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-এর কম হলে পাশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তা সমন্বয় করতে হয়।
উপজেলা শিক্ষা অফিস জানায়, বিয়ানীবাজারের কুড়ারবাজার ইউনিয়নের তিনটি ও চারখাই ইউনিয়নের দুটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা একবারেই কম। এর মধ্যে কুড়ারবাজার ইউনিয়নের ঘাগুরঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মাত্র ৪০ জন, শাহজালাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৩ জন এবং ফাড়িরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০ জন। আবার চারখাই ইউনিয়নের আব্দুল খালিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৫ জন ও সাফা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এদিকে উপজেলায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এর মধ্যে গড়রবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬০০, রামধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫২০।
উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ানীবাজারে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ এসে সেটি বেড়ে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উপজেলায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী আরিফুর রহমান তাদের বাড়িতে গিয়ে উঠান বৈঠক করতেন। বর্তমানে সে উদ্যোগ আর নেই।
উপজেলার আকাখাজনা গ্রামের অভিভাবক মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবু সন্তানকে কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি। কারণ সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়ার মান ও শিক্ষকদের গাইডলাইন ভালো।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির সেতু বলেন, করোনার সময় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়েছে। তবে এখন অভিভাবকরা আধুনিক শিক্ষা ও মানগত কারণে সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করছেন।
বিয়ানীবাজার উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জনি বলেন, শিক্ষকের কিছু সংকট আছে। সেই সংকট কাটানোর চেষ্টা চলমান। আর অভিভাবকদের তো জোর করা যাবে না। তবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পড়ালেখার মান ভালো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফসানা তাসলিম বলেন, ‘সারা দেশে নিয়োগ চলছে। শিক্ষকসংকট কেটে যাবে। আর শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার করোনাকালে বেড়ে গিয়েছিল। এখন তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। তবু যদি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী না হয়, সে ক্ষেত্রে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব আমরা।’