শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। অর্থাৎ শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তর করে দেশ ও জাতিগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মনীষী রাসেল বলেছেন, Teachers are the Architect of Nation and Harbinger of civilization. শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয় আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়; বরং শিক্ষকতা এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে, কালে কালে শিক্ষকরা জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার। অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন? তাই শিক্ষক হলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের মানুষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টা এবং ইউনেস্কো, আইএলও-এর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সদিচ্ছায় ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর অর্জিত হয় ঐতিহাসিক ‘শিক্ষক সনদ’। ১৪৬ ধারা-উপধারা বিশিষ্ট এই সনদে যেমন শিক্ষাকে জাতিগঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি এই সনদে শিক্ষকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা এবং তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশের শিক্ষকদের ২১০টি জাতীয় শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা হলো- ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’। এ সংস্থার ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হয় এবং বিশ্বের সব দেশে ‘শিক্ষক সনদ’ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।
এবারের শিক্ষক দিবসে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে ““The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage”. এবার সরকারিভাবে আমাদের দেশে এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। সরকারিভাবে দিবসটি পালনের জন্য আমরা বার বার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। বিষয়টি বাস্তবে পরিণত হওয়ায় আমরা খুশি।
আমরা জানি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে ইউনেস্কো বা অন্যান্য সংস্থা আয়োজিত শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়নে সরকারের সাফল্যের কাহিনী বর্ণনা করে আসেন। প্রশ্ন থেকে যায়, তাঁদের এই যাওয়া-আসায় দেশের শিক্ষা তথা শিক্ষকদের কতোটুকুই কল্যাণ হয়?
শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও শিক্ষা উপকরণাদি দেয়া হয় সত্য, কিন্তু শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন প্রগতিশীল, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা। শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এ বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত।
উল্লেখ্য, আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৯০ ভাগই পরিচালনা করেন বেসরকারি শিক্ষক, আর একটি স্বাধীন দেশের জন্য এই বেসরকারি শিক্ষকতার অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে এক চার্টারে ১ লাখ টাকা মঞ্জুরির মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার সূত্রপাত করে। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ম্যাকলে উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এদেশের অবস্থার সাথে সঙ্গতিহীন শিক্ষা কাঠামো প্রণয়ন করেন। ক্রমান্বয়ে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে এদেশের ধনাঢ্য দানশীল শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্যোগে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশবিভাগের পর প্রায় একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পরও চলমান ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে এবং তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজো তা বাস্তবায়িত হয়নি।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। তবে যতোদিন শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা সম্ভব হচ্ছে না, ততদিন নিচে আলোচিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সে কারণে ‘শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। তেমনি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থোপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না হয়।
এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। সৌভাগ্যবান কেউ কোনোমতে একধাপ এগোলেও পরবর্তী ধাপে পদোন্নতির কোনো নিয়ম নেই। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনীতিকদের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এবং পরিচালনা কমিটি গঠনে অসঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। আবার শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে তথাকথিত ডোনেশেনের নামে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান ও পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু সরকার বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতনের শতভাগ এবং অন্যান্য ভাতার আংশিক প্রদান করছেন, তাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যে অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ নিয়মে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। সামগ্রিক অবস্থার আলোকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যোগ্য ও আদর্শ শিক্ষকরা চরম হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। ফলে সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটার অবকাশ নেই, বরং তাঁদের সাধারণ দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
তাই আর বঞ্চনা নয়, করুণা নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকতা পেশার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে সম্ভবমত সব চাহিদা মেটানো একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। শিক্ষকের কাজের স্বাধীনতা যেনো তার দায়িত্ব পালনে নেতিবাচকতার নামান্তর না হয়।
এখন প্রশ্ন, এই মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকরা কতোটুকু যত্নবান? কতোটুকু নিষ্ঠাবান? কতোটুকু আন্তরিক? এসব বিষয়ে শিক্ষকদের আত্মবিশ্লেষণের এখনই উপযুক্ত সময়। সারা বিশ্বের শিক্ষকরা যখন একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষকতার চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে নিজেদের প্রস্তুতির কথা ভাবছেন, তখন আমাদেরও ভাবতে হবে কীভাবে নিজেকে আদর্শ শিক্ষকরূপে গড়ে তোলা যায়। সেজন্য শিক্ষক সমাজের মধ্যে একে অন্যের অভিজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, শিক্ষকতা পেশার নীতিবোধের প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং আত্মকর্মের সফলতা ও ব্যর্থতার নিরিখে সঠিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে।
সুন্দর সমাজ, সুন্দর দেশ তথা সুন্দর পৃথিবীর জন্য গুণগত মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে সকল প্রতিকূলতাকে জয় করতে হবে-- এই হোক বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান, সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ