বোর্ড পরীক্ষার ফল পরিবর্তনের চেষ্টা কেনো - দৈনিকশিক্ষা

বোর্ড পরীক্ষার ফল পরিবর্তনের চেষ্টা কেনো

মাছুম বিল্লাহ |

দেশের একমাত্র শিক্ষার প্রিন্ট জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’ একটি সংবাদ প্রচার করেছে। সংবাদটি হচ্ছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের বর্তমান সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নারায়ন চন্দ্র দেবনাথের ছেলেকে কোনো অনিয়ম করে এইচএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখার দাবি জানিয়েছেন বোর্ডের সাবেক সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল আলীম। প্রভাব খাটিয়ে বর্তমান সচিব অবৈধভাবে তার ছেলেকে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন বলেও তিনি অভিযোগ তোলেন। অধ্যাপক আলীমের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে নক্ষত্রের ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করার অভিযোগ তুলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন বর্তমান সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের স্ত্রী বনশ্রী নাথ। জানা গেছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অধ্যাপক আলীম বোর্ড সচিবের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথের এইচএসসি পরীক্ষা ফলে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি—না তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান। তিনি বলেন, পুনর্নিরীক্ষা করলে নম্বর কখনো কমেনা। বাড়লে যুক্ত হয়। পুনর্নিরীক্ষণে তাহলে তাদের এতো ভয় কেনো? বিষয়টি নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে তার সন্তানের রেজাল্টের বিষয়ে তদন্ত হোক। তিনি আরো বলেন, নিজের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে নিজের সন্তানকে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন, একইভাবে প্রভাব খাটিয়ে তার সন্তানের ফল অনুকূলে নেয়া বিচিত্র নয়। তাই তার সন্তানের রেজাল্টের বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার।

বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, চেয়ারম্যান, সচিব ---সবাই কিন্তু বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক। বোর্ডের এই চেয়ারগুলো পাওয়ার পর অনেককেই ভুলতে দেখা যায় যে, তারা কখনও শিক্ষক ছিলেন। চাকরির শেষের দিকে এইসব পদে বসেন বলে অধিকাংশেরই আর শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদানে ফেরত যাওয়া হয়না। তাই তারা প্রশাসকদের মতোই  ভূমিকা পালন করতে পছন্দ করেন। পদে থাকাকালীন অনেকেই সকল বিষয়ে স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেন, অনেকে করেও পারেন না আবার অনেকে পদের বলে এমনকিছু কাজ করে ফেলেন যা, সকলের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। আমরা মনে করি, সামান্য স্বার্থের খাতিরে এইসব পবিত্র পদে বসে কোনোভাবেই এর ধারে কাছেও যাওয়া উচিত নয়। শিক্ষা বিভাগের এসব পবিত্র জায়গায় কলঙ্ক লেপন করা কোনেভাবেই মেনে নেয়া যায়না। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে যে ঘটনাটি ঘটেছে আমরা জানিনা এখানে  ব্যক্তিগত কোনো রেষারেষি আছে কিনা, কিন্তু বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। শিক্ষার কোনো বিষয় যখন কোর্ট পর্যন্ত যায় তখন সেটি অন্যদিকে মোড় নেয়। এটি শিক্ষাকে, শিক্ষার মানকে, শিক্ষা বিভাগের অবস্থাকে কোথায় নিয়ে যায় সে চিন্তা আমরা কেউ করিনা ও করছিনা।

পদে বসে প্রভাব খাটানো, আবার পদে থেকে কোনো ধরনের প্রভাব কিংবা জৌলুস অনেককেই এতটুকু টলাতে পারেনা, সে ধরনের উদাহরণ আমরা জীবনে প্রায় সবাই কমবেশি প্রত্যক্ষ করি । আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম বর্ষে ক্লাস করার সময় অনেক শিক্ষকের কাছে শুনেছি ড. এনামুল হকের কথা। তিনি এক সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। তিনি প্রকৃত শিক্ষাবিদ, প্রকৃত শিক্ষা প্রশাসক। তার সবকিছুকে ছাপিয়ে তার সততা ও কর্মনিষ্ঠার কথা শিক্ষকদের মুখে শুনতাম। তিনি নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন। শিক্ষকদের মূলত এমনই হওয়া উচিত। আমাদের সমাজে ও শিক্ষা কাঠামোতে এমনটি হওয়া খুব সহজ কাজ নয়, কিন্তু এনামুল স্যার হয়েছিলেন। তিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত যে গাড়ি, সেই গাড়িতে শুক্রবার মসজিদে যেতেন না, মসজিদে যেতেন হেঁটে। বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নে এ ধরনের এনামুল হকদের দরকার বলে শিক্ষকরা মন্তব্য করতেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই আর একটি ঘটনা শুনলাম। আমার বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জে। সেখানকার তৎকালীন টিএনও নাকি তার ছেলের এসএসসি পরীক্ষার খাতা পরীক্ষার পর কিছু শিক্ষকের উপস্থিতিতে আবার লিখিয়ে তৎকালীন যশোর বোর্ডে জমা দিয়েছিলেন। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে কিভাবে তারা এগুলো করেন তা বুঝে আসেনা। কি হয় এর বিনিময়ে, কি পাবেন এত বড় অন্যায়ে করে? কিভাবে তারা এটি করেন?

আবার সরকারি কলেজের এমন শিক্ষকের কথাও জানি যিনি সরকারি পেনশনের টাকা নিতে গিয়ে গ্রাচুইটির টাকা নেননি। তার কাগজপত্র তার বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন মাউশিতে গিয়ে সবকিছু জমা দিয়েছেন, তখন তাকে জানানো হলো যে, উনি তো ভুলে গ্রাচুইটি ঘরটি পূরণ করেননি। ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, ইচ্ছে করেই তিনি সেটি খালি রেখেছেন। কারন এমনও হতে পারে যে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সব সময় রাষ্ট্রকে, তার শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত সময় তিনি দিতে পারেননি। হতে পারে অনিচ্ছায় তার কোনো একটি সরকারি কলম তার পকেটে করে বাসায় নিয়ে গেছেন যা তার প্রাপ্য নয় এসব কারণে আরো স্বচ্ছ থাকার জন্য ঐ টাকা তিনি রাষ্ট্রের কাছে সারেন্ডার করেছেন। এই ঘটনা উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখে শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এত সৎ, এত মহৎ শিক্ষক, এতবড় বিবেকমান মানুষ আমাদের সমাজে আছে, আমাদের শিক্ষা বিভাগে আছে! এটি জেনে বর্তমানকালে শিক্ষকদের এবং শিক্ষক থেকে শিক্ষা প্রশাসকদের কি সব ঘটনা শুনি! সব যেনো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়েই আমাদের ইংরেজি বিভাগেই একজন অধ্যাপকের নিয়মিতভাবে বিভাগীয় চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। তিনি এক কনফারেন্সে ফ্রান্সে গেলেন। তার অনুপস্থিতিতে আর একদল শিক্ষক তাদের নেতাকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন। নিয়মিতভাবে যার চেয়ারম্যান হওয়ার কথা তিনি  বিদেশে থেকে এসে দেখলেন যে, ইংরেজি বিভাগে ‘ক্যু’ হয়ে গেছে। এই ক্যু-র ফলে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা কয়েকমাস অযথা পিছিয়ে গিয়েছিলো। পরে উক্ত শিক্ষক হাইকোর্টে কেস করেন, কয়েকমাস পর তিনিই বৈধভাবে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। ক্যু-র মাধ্যেমে যিনি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি আজ পৃথিবীতে নেই। বৈধভাবে যিনি চেয়ারম্যান হলেন, তিনি এখন বয়োবৃদ্ধ। কতটুকু পাওনা, কে কি পেলেন আজও বুঝতে পারিনা! তবে এতটুকু বুঝতে পারি যে, ঐসব পদ বা সীমিত ক্ষমতা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র অঙ্গন এসব কারণে কলুষিত হয়। দ্বিতীয়ত, উনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর যখন বিরোধীদের সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হতো তখন তারা কেমন অনুভব করতেন? বিষয়গুলো খুবই অবাক এবং ছেলেমি মনে হয়। এই ছেলেমি যদি উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যায় তাহলে হৃদয়পটে রক্তক্ষরণ হয়।

আমাদের সামনে বহু প্রমাণ ও উদাহরণ রয়েছে যে, পাবলিক পরীক্ষার ফল কিংবা শ্রেণিকক্ষের তথাকথিত ভাল ছাত্ররা জীবনে সেই অর্থে কিন্তু সফলতা অর্জন করেননা। যেসব শিক্ষার্থী নিজে কিছু করেন, অন্যের জন্য কাজের ব্যবস্থা করেন, নিজে একজন উদ্যোক্তা হন তারা কিন্তু  সাধারণত পাবলিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর বা গ্রেড পাওয়া শিক্ষার্থীরা নন। যে ছেলে বা মেয়েরা শ্রেণিকক্ষে চুপচাপ বসে থাকতেন কিংবা একাডেমিক বিষয়ের বাইরে অন্য কিছুতে পারদর্শিতা প্রদর্শন করতেন তারাই কিন্তু দেশ, সমাজ ও জাতিকে কিছু দিয়ে থাকেন। পাবলিক পরীক্ষার ফল পরিবর্তন করার জন্য নিজের পদের প্রভাব খাটিয়ে যদি এমনটি কেউ করেন সেটি সেই শিক্ষার্থীকের কি দিবে? সেই শিক্ষার্থী তো সারাজীবনের জন্য মানসিকভাবে কলঙ্কিত হলেন, পঙ্গুত্ব বরণ করলেন। আর কোনো অভিভাবক এমনটি করলে তাদের বিবেকই বা কি বলে? বিষয়টি শিক্ষার সঙ্গে আমরা যারা জড়িত তাদের ভীষণভাবে লজ্জিত করে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0082998275756836