স্কুলে ভর্তিতে জন্মসনদের চক্রাকার ভোগান্তিতে খাবি খাচ্ছেন অভিভাবকরা। কিছু দিন পরই শুরু হবে আসন্ন শিক্ষাবর্ষে ভর্তিযজ্ঞ। সদ্য প্রকাশিত শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছর বয়সী শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবেন। পুরো প্রক্রিয়া লটারিতে সম্পন্ন হবে বলে ভর্তিযুদ্ধের হ্যাপাও কম। কিন্তু অভিভাবকরা শঙ্কিত তাদের জন্মসনদ নিয়ে। কারণ, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দেই শিশুর জন্মসনদের জন্য অভিভাবক বা বাবা-মায়েরও জন্মসনদ জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে তৎকালীন সরকার। সে অনুযায়ী সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে ভর্তিচ্ছুর জন্মসনদের সঙ্গে তার বাবা-মায়েরও জন্মসনদ জমা দিতে হচ্ছে। ফলে বিড়ম্বনার অন্ত থাকছে না।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিশুর বয়স শনাক্ত করতে আবেদন ফরমের সঙ্গে জমা দিতে হয় জন্মসনদের ফটোকপি। তার সঙ্গে বাবা-মায়ের জন্মসনদ দেয়ার নিয়ম চালু হওয়ার পর বিদ্যালয়ে ভর্তি ঘিরে প্রতিবছরই সেপ্টেম্বর বা তার আগে থেকেই শিশুর জন্মসনদ সংগ্রহে অভিভাবকদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে মাসের পর মাস ঘুরেও অনেকে জন্মসনদ পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, বংশাণুক্রম নির্ধারণের চিন্তা এবং পারিবারিক ধারাবাহিকতা মেলাতে আওয়ামী লীগ সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিলো। সম্পদের উত্তরাধিকার যেনো সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যাদের জন্ম ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পর তাদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। তারপর থেকেই ভোগান্তি বেড়ে যায় অভিভাবকদের।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, আগে বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানো যেতো। কিন্তু, অভিভাবকদের জন্মসনদের বিধান পরিস্থিতিকে অহেতুক জটিল করে তুলেছে। এতে যতোটা না ভালো হয়েছে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাগ্রহিতারা। অনেকের বাবা-মা মারা যাওয়ায় তাদের জন্মসনদ নিতে যেসব তথ্য দরকার সেগুলো দিতে পারছেন না। ফলে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, এখন যারা অভিভাবক তাদের জন্মের সময়ে জন্মসনদ নেয়ার চর্চাই ছিলো না। পরিণত বয়সে এসে শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য সনদের কাগজ করিয়ে নেয়ার মানে নেই। বরং এই পদ্ধতি অনেক অনিয়মের জন্ম দিচ্ছে। জন্ম নিবন্ধনে বংশাণুক্রম নির্ধারণের জটিলতা এড়াতে অনেক অভিভাবকই জন্ম নিবন্ধন অফিসের কর্মচারীদের ম্যানেজ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাদা–দাদির ভুয়া তথ্য দিয়ে সনদ তৈরি করা হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে উৎকোচের বিনিময়ে লিখে দেয়া হচ্ছে বাবা-মায়ের সনদের তথ্য।
উপরন্তু, এই নিয়ম শুধু চক্রাকার ভোগান্তিই তৈরি করেনি, এর কারণে প্রাথমিকের সব শিশুকে উপবৃত্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান জানিয়েছেন, এবার তার দুই সন্তান সাদমান মুকতাদির ও সালাম মুকতাদিরকে স্কুলে ভর্তি করাবেন তিনি। সন্তানদের জন্মসনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক কার্যালযয়ে যান। সেখানে সন্তানদের জন্মসনদের জন্য বাবা-মায়েরও জন্মসনদ চাওয়া হয়। এটা ছাড়া অনলাইনে আবেদনই করা যাচ্ছে না।
তবে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘পুরো বিষয়ে বলতে হলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।’
‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে জন্মনিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৯৮। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তা লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ২৬১টিতে। সবশেষ ১০ নভেম্বর জন্মনিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৫৫। জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৩৩ হাজার ৯১৮টি।
যদিও এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের জেরে জুলাইয়ে দেশজুড়ে জন্মনিবন্ধনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্দোলনের সময় ১৮ থেকে ২৩ জুলাই টানা পাঁচ দিন মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট–সংযোগ বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট–সংযোগ বন্ধ ছিল প্রায় ১০ দিন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানরা আত্মগোপন করেন। কার্যালয়গুলোয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা করা হয়। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। এসব কারণে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বড় অংশজুড়ে অনেক জায়গায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে জন্মনিবন্ধনের আবেদন বাড়তে থাকে। বর্তমানে অসংখ্য আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আরো অগণিত অভিভাবক আবেদনই করতে পারছেন না বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে যেকোনো শিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে গেলে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। এছাড়াও নতুন পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, সরকারি-বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকায় নাম তোলা, জমি রেজিস্ট্রেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিসহ প্রায় ১৮ রকম নাগরিক সেবা মেলে জন্মসনদে।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।