জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখে যে জিনিসটি সেটি হলো তার ভাষা। একটি শিশু জন্মের পরই কেঁদে উঠে অর্থাৎ সে কিছু একটা বলতে চায়, হয়তো তার কষ্টের কথা অথবা অন্য কোনো অনুভূতির কথা। শিশুটি অনুভব করে তার একটি ভাষা প্রয়োজন কিন্তু তখন পর্যন্ত তার নির্দিষ্ট কোনো ভাষাজ্ঞান না থাকায় সে শুধুই ওঁয়াও ওঁয়াও শব্দ করে। এক পর্যায়ে সে তার মাকে অনুকরণ করে মা বলতে শেখে। ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান সে পায় মা-বাবা অথবা তার পরিচর্যাকারীর কাছ থেকে। যেখানে সে লালিত-পালিত হয়, বেড়ে উঠে সেটিই তার প্রাথমিক স্কুল যেখানে শিশুর ভিত মজবুত অথবা নমনীয় হয়ে গড়ে উঠে।
বাংলাদেশে আমাদের সবারই মাতৃভাষা বাংলা অথচ এলাকাভেদে এই বাংলা ভাষাই কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে সিলেট এবং চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষা বাংলা হলেও সে ভাষা সঠিক বুঝে উঠতে পারা অন্য জেলার কারো পক্ষে রীতিমত দুষ্কর। যে কারণে অনেকেই বলে থাকেন বাংলা ভাষা সিলেটে আহত এবং চট্টগ্রামে নিহত হয়েছে। শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার যেমন একটি কঠিন কাজকেও সহজ করে এনে কাজ উদ্ধারে সহায়তা করে ঠিক তেমনই ভাষার অস্পষ্টতায়, অপব্যবহারে শ্রোতার সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি, সম্পর্ক নষ্ট, এবং প্রথমে হাতাহাতি, মারামারি থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে। ভাষার শ্রুতিমধুরতা মানুষকে আকৃষ্ট ও ঘায়েল করবার একটি মুখ্য অস্ত্র যার সফল ব্যবহার মানুষের চলার গতিপথ আমূল পাল্টে দিতে সক্ষম।
বাক্যে শব্দচয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পাক জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তার A stranger in my own country বইতে লিখেছেন, শেখ মুজিব শব্দচয়নে খুব সাবধানী ছিলেন। ’৭১ এর ৭ মার্চের আগে শেখ মুজিবকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিলো যে পল্টনের জনসভা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরাসরি মনিটর করা হবে এবং বেতারেও প্রচারিত হবে (যদিও সরাসরি বেতারে প্রচার করতে দেয়া হয়নি, পরদিন প্রচারিত হয়েছিলো), মুজিব যদি ঐ মাঠের বক্তৃতায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসেন অথবা উস্কানিমূলক কিছু বলেন তবে আকাশ থেকে বিমান আক্রমণ চালিয়ে সভাস্থল ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হবে। কাজেই বক্তৃতায় শব্দ চয়নে মুজিব সতর্ক ছিলেন, তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত ছিলেন যদিও নেতাকর্মীদের চাপ ছিলো ঐ মাঠেই যেনো তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ‘স্বাধীনতা ঘোষিত হলো’ এই শব্দত্রয়ের পরিবর্তে তিনি ‘সংগ্রাম’ শব্দটি বেছে নিয়ে বললেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের কথা আমরা জানি। আব্রাহাম লিংকনের ২৭২ শব্দের এবং মাত্র ২ মিনিট স্থায়ী একটি ভাষণ কীভাবে আমেরিকার তো বটেই এমনকি সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো। গণতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হিসেবে এখনও সারাবিশ্বে ঐ ভাষণের অংশবিশেষ ..and that government of the people, by the people and for the people- এই বাক্যাংশকে ব্যবহার করা হয়। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ গোটা জাতিকে সেদিন একতাবদ্ধ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। বঙ্গবন্ধুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি ছিলো না কিন্তু তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘ অসাধারণ একটি রচনা। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো আরো কম কিন্তু শব্দের যাদু দিয়ে তিনি অনুসারীদের আকৃষ্ট করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রাখতেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতা ও গান ১৯৭১ এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের রণক্ষেত্রে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিলো দারুণভাবে। শুধু কি তাই, যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হতে এম আর আখতার মুকুলের রচিত এবং পঠিত স্বাধীনতার চরম পত্র সেদিন বাংলার আপামর জনগোষ্ঠী যারা স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যারা স্বাধীনতার প্রতীক্ষা করছিলেন অধীর আগ্রহে, সবাইকেই উদ্দীপ্ত করেছিলো। সংগীতে শব্দ ব্যবহারের কারিশমা রবিঠাকুরকে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতায় পরিণত করেছিলো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সব সংগীতের ভাষা কিন্তু শুদ্ধ নয়, বিশেষ করে লালন এবং হাসনের গানে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে(কেমনে) আসে যায়।’ সূফী দার্শনিক লালন ফকির কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন বিধায় তার সংগীতে আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব পড়েছে। গাইবার সময় লালনের ভাষায় গাইলেও আমরা তার ভাষাকে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবহার করতে পারি না। এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।বলা বাহুল্য যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখভাগ কিন্তু সে দাবি আদায়ের পর ভাষা রক্ষায় যথেষ্ঠ উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করেই যেনো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ইদানীং প্রায় দেখা যায় বেশিরভাগ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীই সঠিক ও শুদ্ধ বাংলায় একটি আবেদনপত্র লিখতে পারেন না, আঞ্চলিক ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণে হাস্যকর এক অদ্ভুত ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করে থাকেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চিত্র ও নাট্যশিল্পীদের উচ্চারণ কত মনোমুগ্ধকর অথচ আমাদের দেশের নায়ক-নায়িকা, চিত্রতারকা, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বাংলা উচ্চারণ শুনলে একজন ভাষা-সচেতন নাগরিকের লজ্জা ও ক্ষোভে মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হতে হয় তখন যখন একজন শিক্ষক শিক্ষাদানকালে শ্রেণিকক্ষে অশুদ্ধ বাংলায় বা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, যখন একজন মিডিয়া কর্মী প্রচার-মাধ্যমে এসে বাংলা-ইংরেজি-আঞ্চলিক ইত্যাদির জগাখিচুড়ী করে উপস্থাপন করেন। শুধু শিক্ষকদেরই নয়, অনেকেই প্রচার মাধ্যমে উপস্থাপকের ব্যবহৃত ভাষাকে শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে যদি সতর্কতার সঙ্গে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করা না হয় তবে ভাষার ভবিষ্যৎ কোথায়? যদিও অনেক বিতর্ক আছে তথাপিও বাংলা একাডেমি নির্দেশিত প্রমিত বাংলাকেই আমরা এখন শুদ্ধ বাংলা হিসেবে গ্রহণ করেছি কিন্তু বাংলা একাডেমির অভিধান কয়জন ব্যবহার করেন এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। শুধু একটি শব্দের বানান নয়, উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে এক এলাকার মানুষকে অন্য এলাকায় গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ড. আকবর আলি খান তার ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ বইতে লিখেছেন একটি বিশেষ এলাকায় বদলির পর নতুন কর্মস্থলে যোগদানের প্রথম দিনেই তার অধীনস্ত একজন কর্মচারি যখন তাকে ষাঁড়(স্যার) বলে সম্বোধন করলো তখন তিনি অপমানিত বোধ করলেন এবং তার বিরুদ্ধে দাপ্তরিক ব্যবস্থা নেবার জন্য মনস্থির করলেন কারণ তিনি জানতেন না যে ঐ এলাকায় স্যারকে ‘ষাঁড়’ উচ্চারণ করা হয়, সাপকে ‘ছাঁপ’ উচ্চারণ করা হয়। সব এলাকায় যদি শব্দের সঠিক উচ্চারণ করা হতো তবে এমন বিড়ম্বনা পোহাতে হতো না। একজন শিক্ষিত ব্যক্তির সামান্য একটু সচেতনতাই এমন বিড়ম্বনা থেকে রেহাই দিতে পারে।
দু’একবার বিদেশ ঘুরে আসা অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাটা আমার ঠিক সেভাবে আসে না’ – ভাবখানা এমন যে তিনি ইংরেজি বা ফরাসি ইত্যাদিতে খুবই পারদর্শী কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অন্য চিত্র, তিনি কোনো ভাষাই সঠিকভাবে বলতে বা লিখতে পারেন না। নিজের মাতৃভাষাকে খাটো করার এ জাতীয় হীন মানসিকতা অচিরেই পরিত্যাজ্য। মাতৃভাষাকে অসম্মান করার অর্থ নিজেকে, নিজের দেশকে অসম্মান করা। কাজেই ভাষার মহিমা, মাহাত্ম্য বিবেচনায় নিয়ে শুদ্ধভাবে কথা বলা ও লেখায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়