বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (এনএসটি) ফেলোশিপ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিপুল রায়ের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা।
আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও ‘অবৈধভাবে’ ইবির ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে নিয়োগ পান বিপুল রায়। বিভাগে শিক্ষক হওয়ার পর অনিয়ম ও সন্ত্রাসী কাজের ইন্ধনে তার নাম উঠে আসে।
বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সহকারী অধ্যাপক বিপুল রায় বিভাগের তৎকালীন সভাপতির সিল জালিয়াতি করে ও ভুয়া সুপারভাইজার সেজে অনিয়মিত ছাত্র মাহমুদুল হাসানকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এনএসটি ফেলোশিপ (সেশন ২০২৩-২৪) পেতে সহায়তা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, ‘বিপুল রায় শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় মাহমুদুল হাসানের পক্ষে এনএসটি ফেলোশিপে আবেদনে সহায়তা করেছেন। দলীয় বিবেচনায় নিজের পছন্দের একজন ছাত্রের পক্ষে অনিয়মিত ছাত্র হওয়ার পরও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এরকম বৃত্তিতে আবেদনে করে তিনি অনৈতিক কাজ করেছেন। অথচ নিয়মিত শিক্ষার্থীদের এই আবেদন করতে দেওয়া হয়নি। মাহমুদুল হাসানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আর আমাদেরকে সুযোগ না দিয়ে, আমাদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে।’
ফেলোশিপ নিয়ে কী ঘটেছিল
থিথিস সুপারভাইজার নির্বাচন শেষ না হওয়ায় গত বছর স্নাতকোত্তর শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এনএসটি ফেলোশিপে আবেদন করতে ছাড়পত্র দেয়নি ইবির ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ। শিক্ষার্থীদের ফেলোশিপে আবেদনের সুযোগ না দেওয়ার কারণ হিসেবে ওই সময় বিভাগ থেকে জানানো হয়েছিল যে, ‘শিক্ষার্থীদের থিসিস সুপারভাইজার নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।’ এ কারণে আবেদনের শেষ তারিখ পার হয়ে যাওয়ায় বিভাগের কোনো শিক্ষার্থীই ফেলোশিপে আবেদন করতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এনএসটি ফেলোশিপের ভাইভা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে অনিয়মিত ছাত্র মাহমুদুল হাসানের (রোল: ২১৩১১৭) নাম দেখে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। বিপুল রায়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে বিভাগের সবার অজান্তে একমাত্র ছাত্র হিসেবে মাহমুদুল হাসান সেই ফেলোশিপ পান।
অনিয়মিত ছাত্র যেভাবে ফেলোশিপ পেয়েছিলেন
মাহমুদুল হাসান ২০২৩ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হলেও কোনো ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। সেই হিসেবে তিনি অনিয়মিত ছাত্র। তাকে বিশেষ বিবেচনায় কেন আবেদনের সুযোগ দিয়ে অন্যদের বাদ রাখা হলো, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী অনিয়মিত ছাত্র মাহমুদুল হাসান এই ফেলোশিপে আবেদন করতে পারেন না। তার ফেলোশিপ আবেদনে সুপারভাইজার হিসেবে স্বাক্ষর করেন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে বিভাগের সভাপতি) বিপুল রায়। তিনি স্বাক্ষর করলেও বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের থিসিস সুপারভাইজার বণ্টনের তালিকায় মাহমুদুল হাসানের নাম ছিল না।
এ ছাড়া ফেলোশিপ আবেদনের অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ ছিল, কোনো কারণে কোর্স বা গবেষণা ত্যাগ করলে তা দুই মাসের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। কিন্তু মাহমুদুল হাসান সেটা জানাননি। শুধু তাই নয়, ফেলোশিপ অর্জনের ছয় মাস পর মাহমুদুল হাসান গবেষণার অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেন। তবে তিনি প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষাসহ পূর্ববর্তী সব ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলেন। তার সেই গবেষণার অগ্রগতি প্রতিবেদনে বিভাগের তৎকালীন সভাপতি ইনজামুল হকের স্বাক্ষরের জায়গায় জালিয়াতি করে বিপুল রায় স্বাক্ষর করেন।
বক্তব্যে যা জানা গেল
ফেলোশিপ অনিয়মে জড়িত ছাত্র মাহমুদুল হাসান এখন জার্মানিতে রয়েছেন। ম্যাসেঞ্জারে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘অনিয়ম করে আবেদন কীভাবে করা যায়, বলেন?’
মাহমুদুল হাসান আরও বলেন, ‘আমার এনএসটি ফেলোশিপ পাওয়ার কাগজে সেসময়কার চেয়ারম্যান নিজে স্বাক্ষর করে অ্যাপ্রুভ করেছেন। আর তিনি ইনজামুল হক সজল স্যার।’
এ বিষয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক সভাপতি ইনজামুল হক বলেন, ‘তার (মাহমুদুল হাসান) টাকা অ্যাপ্রুভের বিষয়টি যখন আসে, ওই সময় আমি ডিপার্টমেন্টেই ছিলাম। আমার এক কলিগ খবর দেয় যে, মাহমুদুলের নাম আসছে। আমি খুব অবাক হই যে, মাহমুদুলের নাম তো অ্যাপ্রুভ করা হয়নি, তাহলে ওর নাম কিভাবে এলো আর টাকা কীভাবে পেল?’
তিনি আরও বলেন, ‘খবর নিয়ে জানতে পারি, ফেলোশিপের টাকা তুলতে বিভাগের সভাপতি ও সুপারভাইজারের স্বাক্ষর লাগে। তখন বিপুল স্যারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ভুল হয়েছে মর্মে আমাকে স্যরি বলেন। সেসময়েই এনএসটির এই আবেদনটিকে আর ফরওয়ার্ড না করার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু পরে আমাকে না জানিয়ে আবেদনটি ফরওয়ার্ড করে দেন বিপুল স্যার। তিনি বিভাগের সভাপতি ও সুপারভাইজারের স্বাক্ষর দিয়ে সেটা অ্যাপ্রুভ করে দেন। সেসময় বিভাগের সভাপতির সিলও ব্যবহার করেন তিনি। অথচ আমাকে জানানো হয়নি, যদিও ওই সময় আমি বিভাগে উপস্থিত ছিলাম।’
ভুয়া সুপারভাইজার হওয়া এবং বিভাগ সভাপতির সিল জালিয়াতির বিষয়ে সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেননি ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বর্তমান সভাপতি বিপুল রায়। জালিয়াতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের ঘটনা, তবে এমন (জালিয়াতি) হয়েছে বলে আমার মনে নেই।’
সিল জালিয়াতির বিষয়ে বিপুল রায় বলেন, ‘না না, সিল জালিয়াতির কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’ তাহলে ইনজামুল হকের কাছে কেন দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটা আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, সেটাতেই। এখানে সিল জালিয়াতির বিষয় নেই।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. মো. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আবেদনের একটা অনুলিপি আমার দপ্তরে এসেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রক্টরিয়াল বডির সঙ্গে বসে কথা বলব। ১৬ ডিসেম্বরের পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’