মহান স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য - দৈনিকশিক্ষা

মহান স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ |

বাঙালি জাতির জীবনে অনন্য একটি দিন। ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। এ দিনে জাতি স্মরণ করছে বীর শহীদদের৷ স্বাধীনতা দিবস তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়া এক রক্তাক্ত ইতিহাস। পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়া স্বাধীনতার ৫২ তম বার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে প্রতিবছর দিবসটি উদযাপন করে গোটা জাতি। বিনম্র শ্রদ্ধা  ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী বীর সন্তানদের। শ্রদ্ধা জানায় মহান স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শ্রদ্ধা জানায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নেতৃতৃন্দকে।  লাখো শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের প্রতি নিবেদন করে হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন থেকে নেমে আসা ভালোবাসার নির্যাস।   

ভাষা আন্দোলন থেকে ৭ মার্চ। গোটা দীর্ঘ সময়ের সংঘাতময় রাজনীতির নির্যাসে নির্মিত হলো একটি ভাষণ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অতঃপর একটি কালো রাত পেরিয়ে ২৬ মার্চ ১৯৭১। স্বাধীনতার ঘোষণা এলো। দিলেন বঙ্গবন্ধু।

ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের পশ্চিমে- পশ্চিম পাকিস্তান ও পূবে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। জন্মের পর থেকেই বৈরীতা। জাতি হিসেবে, প্রকৃতি জলবায়ূ ও স্বভাব, কোথাও কোনো মিল নেই। এমনকি ভাষাও ভিন্ন। পূবের সঙ্গে পশ্চিমের দূরত্ব প্রায় ২২০৪ কি:মি:। মাঝখানে ভারতের মতো এক বিশাল দেশ। জন্মটা শুভ হতে পারেনি। দেশটি যে টিকবে না, আশঙ্কা ছিলো অনেকের। যুক্ত হলো বৈষম্য। ক্রমাগত তা বাড়তে বাড়তে ’৭১-এ বিষ্ফোরণ।  এলো ২৫ মার্চ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ। গভীর রাতে নেমে এলো নারকীয় তান্ডব। ক্ষত-বিক্ষত হলো পাললিক ভূমি। আদমের রক্তে লাল হলো পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। গ্রেফতার করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে গ্রেফতারের কিছু আগেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন।

জাতির জনকের ঘোষণা: ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’

২৬ মার্চ চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মাইকিং করে প্রচার করা হয়। পরে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে পুনরায় তা পাঠ করেন।

অর্জনের সংগ্রাম একদিনে সংঘটিত হয়নি; ধীরে ধীরে এ সংগ্রাম মহিরুহের রূপ পেয়েছে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন ছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সোপান। ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষা আন্দোলনেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিলো। এরপর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা প্রণয়ন ও তৎপরবর্তী আন্দোলন এবং ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থানে এবং জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি মাইল ফলককে স্পর্শ করা। যে ফলকের নাম ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। যে ভাষণের মধ্যে দিয়েই আজকের স্বাধীনতা।  

জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি প্রত্যেক বাংলাদেশির জীবনে বয়ে আনে একই সঙ্গে আনন্দ-বেদনা-গৌরবের এক অম্ল-মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে মুক্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছাড়িয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর আসে আত্মত্যাগ, আত্মপরিচয় ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আসে এই দিন। আমাদের উচিত এই দিনটিকে শক্তিতে পরিণত করে নতুন দিনের পথে এগিয়ে চলার।

স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিলো একটি শোষণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রাষ্ট্র প্রবর্তন করা। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবাইকে স্বনির্ভর করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই লক্ষ্য নিয়েই দেশ গঠন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন একনায়ক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯০-এ স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে পুনরায় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা সূচিত হয়। 

স্বাধীনতা অর্জনে এদেশের মানুষ সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ত্রিশলাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে— সম্ভ্রম হারিয়েছেন কয়েক লক্ষ মা-বোন। আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। এদেশের সর্বস্তরের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তখন দেশীয় এই রাজকারদের তৎপরতায় বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। বহু মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেরা হত্যা করেছে, পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে এই রাজাকার বাহিনী। দেশের অভ্যন্তরে এই শত্রুদের বিনাশ করে স্বাধীনতা অর্জন করতেই মুজিবনগরে গঠিত হয় অস্থায়ী সরকার। 

স্বাধীনতার অধিকার নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বর্তমানে দেশে ও বিশ্বে পরাধীনতাই যেন সবাইকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। আমাদের সমাজেও সুপ্তভাবে এই প্রক্রিয়াটি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ভুললে চলবে না আমাদের স্বাধীনতা অনেক রক্তের দামে কেনা; শহীদদের এই পবিত্র রক্তের দায় জাতি হিসেবে আমাদের সবারই। সেই দায় শোধ হতে পারে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার মধ্য দিয়ে। এই প্রত্যয় নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের পথে । স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। এ ছাড়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনাকে কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। মূলত যথেষ্ট সচেতন ও সংঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হয় এবং সদা সতর্ক থাকতে হয়। তাই স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে একে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য এবং দিবসের প্রত্যাশা।

লেখক : ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ, কলামিস্ট   

 

৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003007173538208