মানুষ অন্যসব প্রাণী বিশেষ থেকে আলাদা তার মানবিকতার জন্য। আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছেছি যখন মানুষের জন্মগত অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য, সেই মানবিক বোধ ও গুণকে ফেরি করে বেচাকেনার হাটে পণ্য মনে করে বিক্রি করে চলেছেন কিছু মানবিকতার ফিরিঙ্গি, বণিক শ্রেণি। ফেরি বা হাঁকডাক করে তো সেটা বিক্রি করতে হয় যেটা অচল পণ্য, ভালো ও গ্রহণযোগ্য পণ্য তো ফেরি করে বিক্রি করতে হয় না। আমাদের এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে সব প্রাক্তন তৈজসপত্রের ফেরিওয়ালারা তাদের সেই পুরনো পেশা ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করেছে মানবিকতার সওদাগর হিসেবে। আর সেই ফেরিওয়ালাদের ফেরির মাধ্যম হয়ে উঠেছে ডিজিটাল ফেসবুক লাইভ অপশন। মানুষকে আবেগে ভুলিয়ে তারা বিক্রি করে চলেছেন মানবিকতার নামে নিজেদের স্বার্থকে। মানুষের আবেগ ও ধর্মকে পুঁজি করে এরা তাদের নিজেদের স্বার্থে বাণিজ্য করে চলছেন খুব সুকৌশলে।
সম্প্রতি মিল্টন সমাদ্দার নামে এক মানবতার সওদাগরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। তিনি মানবতার নাম করে ভয়ানক সব অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট নাকি তিনি নিজেই দিতেন এবং নিজের তৈরি বৃদ্ধাশ্রম নামক বাণিজ্যিক কারখানা থেকে মানুষের কিডনিও বিক্রি করেন তিনি। ফেসবুক লাইভে এসে মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে রাস্তাঘাট থেকে দরিদ্র অসহায় মানুষদের তুলে আনেন তার ওই ‘বাণিজ্যিক সার্ভিস সেন্টারে’।
মিল্টন সমাদ্দার সম্পর্কিত বিভিন্ন অপকর্মের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর যখন ফেসবুক ও মিডিয়াজুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতো তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন আমি মিল্টন সমাদ্দারের ফেসবুক পেজে গিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে এলাম। এতো বড় মানবতার সওদাগর সম্পর্কে এমন অভিযোগ আসলে ব্যাপার কী? ফেসবুক পেজে গিয়ে যেটা দেখলাম সেটা হচ্ছে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রম নামক বাণিজ্যিক সার্ভিস সেন্টার থেকে লাইভে এসে সবার সম্মুখে নিজেকে কলিযুগের কেষ্ট রূপে তুলে ধরেন এবং পরবর্তীতে তার ফ্যান ফলোয়ারদের ওইসব দরিদ্র অসহায় মানুষদের কথা বলে নানান কৌশলে মানবতার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেন এই মানবতার সওদাগর। তার ফেসবুক ফলোয়ার ১৮ মিলিয়ন ভাবা যায়!
অবশেষে এটা বুঝতে সক্ষম হলাম, তিনি বাংলার আবেগপ্রবণ মানুষের আবেগের নিয়ন্ত্রণ যে পাকাপোক্তভাবে নিজের অঙ্গুলির খাঁচায় বন্দি করতে সক্ষম হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার এই অমায়িক স্ক্রিপ্ট ছাড়া অভিনয় দেখে আমি অনেকটা অবাকই হয়েছিলাম। অথচ এই অভিনয়শিল্পীকে যদি অরিজিনাল অভিনয়ের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতো তাহলে আমরা হয়তো ভালো একজন অভিনয়শিল্পী পেতাম!
এ রকম অনেকে নিজের মানসিক মানকে বিক্রি করে হয়ে উঠছে মানবতার ফেরিওয়ালা। কারণ, তারা এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, এই অঞ্চলের মানুষকে বোকা বানানোর জন্য খুব বেশি কিছু করতে হয় না। কিছু কলা-রুটি কিনে ফেসবুক লাইভে এসে মা-বোন বলে ডেকে ডেকে তাদেরকে তা বিলিয়ে দিলেই হয়ে ওঠা যায় মানবতার ফেরিওয়ালা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় সমাজকর্মী ও মানবিক মানুষ হিসেবে! এই সব ভণ্ড মানবিক ফেরিওয়ালাদের জন্য সত্যিকারের যারা হৃদয় থেকে মানুষের জন্য কাজ করেন বা করে যাচ্ছেন তাদেরকেও মানুষ এখন সন্দেহের চোখে দেখছেন।
মানবিক চেতনার পরম স্পর্শকে যারা ব্যক্তিস্বার্থের কারণে লোক দেখানো হরেক মালের কাতারে দাঁড় করে বেচাকেনা করেন তারা কখনোই সত্যিকারের মানবিক বোধকে বা মমতাকে ধারণ ও লালন করেন না। আমি এমন কিছু মানুষকে চিনি যারা মানুষকে ভালোবাসেন, মানুষের জন্য নিজের সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম। যারা মানবিকতাকে ব্যবসার কাতারে না নামিয়ে মানবিকতাকে নিভৃতে ধারণ করে পরম মমতার ছোঁয়ায়, পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন দরিদ্র অসহায় মানুষদের তেলহীন মরুভূমির মতো উষ্কখুষ্ক মাথায় প্রচণ্ড গোপনে ও নিভৃতে। গভীর মমতার কেন্দ্রে যারা স্বয়ং মানবতার পটচিত্র অঙ্কন করছেন প্রতিনিয়ত, অথচ কী নীরবে, নিভৃতে কেউ তা জানেন না। মানবতা নামক ঐশ্বরিক দানকে যারা সবসময় জানান দেয়ার ধান্দায় থাকে তাদের উদ্দেশে নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ রয়েছে। মানবতা এমন এক অনুভূতির জাগরণ যা মানুষকে নিভৃতে স্বর্গ সুখের অনুভূতি দেয়, যার সৃষ্টি স্বয়ং স্রষ্টার হৃদয় থেকে। আর এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে মানবতার ফেরিওয়ালা নামক ব্যবসায়ীরা দাঁড় করিয়েছেন ব্যক্তিস্বার্থের নিজস্ব খনির অতল গহ্বরে।
কিছু মানবতার ব্যবসায়ী আবার যুক্তি দেন, দেখিয়ে দেখিয়ে মানবতা বিক্রি করলে সবাই উদ্বুদ্ধ হবেন। পৃথিবীতে মানুষের আত্মসম্মান বোধ অন্য সব প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি। অন্য প্রাণীর ভেতর এমনটা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। তাহলে যখন আপনি কাউকে কোনো বিষয়ে উপকার করবেন এবং সেটা প্রযুক্তির মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেবেন তখন যিনি গ্রহীতা তিনি ভেতরে ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যান। কারণ, পৃথিবীতে কোনো মানুষ তার করুণ অবস্থার কথা অন্যকে জানাতে চান না। আমি এমন এক ভিক্ষুককে চিনি যার তিন তিনটি অবিবাহিত মেয়ে আছেন এবং কোনো ছেলে নেই। তিনি নিজেও শারীরিকভাবে অক্ষম। ঢাকায় ভিক্ষা করেন অথচ গ্রামের মানুষকে সেটা জানতে দেননি। কারণ, তিনি চান তার মেয়েদের যেনো ভালো জায়গায় বিয়ে হয় তার এই পেশাগত কারণ যেনো তার মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি না করে।
আরেকজন নারীকে দেখেছিলাম মানবতার সওদাগরদের বলছেন, ‘বাজান, তোমরা কাপড়টা আমার হাতে দিয়ে যে ছবি তুললা ছবিখানা কিন্তু টিপিতে ছাইড়ো না। আমার জামাই দেখলে কিন্তু আমার মাইয়াডারে রাখবো না।’ কিন্তু সওদাগররা তা শোনেননি। ফেসবুকে সে ছবি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাণিজ্যকে সচল রেখেছিলেন।
তাহলে প্রতিটি মানুষ তার অর্থনৈতিক হোক বা অন্য যেকোনো দুর্বলতা খুব কাছের মানুষ ছাড়া অন্যকে জানাতে চান না। এটা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আর সেই গোপনীয় বিষয়কে মানবিক বণিকের দল দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন সারাদেশ ও সমগ্র পৃথিবীকে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
ধর্মও দানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে। ধর্ম দানের ক্ষেত্রে বলেছে, যে হাত দান করবে অন্য হাত যেনো না জানে। খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টিকে বর্ণনা করেছে। কোনো ধর্মই দানের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ও লোক দেখানো প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে না। কিন্তু আমরা ঠিক তার উল্টোটা করছি। জাহির করাটাকে আমরা অগ্র কর্তব্য বলে মনে করছি।
এই মানবিক ফেরিওয়ালা শব্দটার সঙ্গে এখন আমার ঘোর আপত্তি আছে। কারণ, কোনো বস্তু বা শব্দ যখন তার যথাযথ গুরুত্ব হারিয়ে অন্য কিছুতে পরিণত হয় তখন সে শব্দ আর শব্দ থাকে না, শব্দদূষণে রূপান্তরিত হয়। আমাদের এই মানবতার ফেরিওয়ালা শব্দটিও সে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। পৃথিবীতে এমন অনেক শব্দ ছিলো যা একসময় ছিলো অর্থবহ ও গুরত্বপূর্ণ কিন্তু পরবর্তীতে কিছু অসাধু শব্দ বণিকের খপ্পরে পড়ে তা পরিণত হয়েছে অপশব্দে। সেক্ষেত্রে এই শব্দটিও ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদি এই শব্দটিকে যথাযথ পরিচর্যা ও উদ্যোগে এখনি রক্ষা করা না হয় তাহলে এই শব্দটিরও বিলুপ্তি ও কার্যকারিতা হারাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আমাদের সবার এই মানবতার সওদাগরদের বিষয় সতর্ক হতে হবে। আমাদের এই মানবতার মধুকরদের দ্বারা নির্মিত মোহাচ্ছন্ন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ফেসবুক লাইভে এসে কলিযুগের কেষ্ট রূপে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করলেই যেনো তাকে আমরা বিচার-বিবেচনাহীনভাবে মানবিকতার পরম বেদীতে বসিয়ে না দিই। তাহলে একদিক দিয়ে তাদের হাতে অপহৃত হওয়া ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ শব্দটি যেমন পুনরুদ্ধার করা যাবে, ঠিক তেমনি ভণ্ড মানবিকতার সওদাগরদেও সম্মিলিতভাবে রুখে দেয়া সম্ভব হবে।
লেখক: কলামিস্ট