রংপুরে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) এর ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে সম্প্রতি উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হাসিবুর রশীদ এর মুখোমুখি হয়েছিলো দৈনিক আমাদের বার্তা। তার বিশেষ সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হয়।
আমাদের বার্তা: আপনি করোনাকালে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছেন। দায়িত্বের শুরুতেই ক্যাম্পাস ছিলো বন্ধ। শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
উপাচার্য: তখন করোনার কারণে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। শিক্ষা কার্যক্রমে একেবারেই অচলাবস্থা। দায়িত্ব নিয়েই শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করি। আমার মনে হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে না। বিকল্প পথ বের করতে হবে। আমার প্রথম পদক্ষেপই ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিজিটাল সিস্টেমে এনে অনলাইনে কাজ করা। জাতীয় ও বৈশ্বিক দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা আয়োজনের জন্য ‘অনলাইন পরীক্ষা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটি’ করি। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সকল অংশীজনের আন্তরিক সহযোগিতায় এই কমিটি অনলাইনে ক্লাস, ভর্তি, ফরম ফিল-আপ ও পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সূচনা করে। এই কার্যক্রমের আওতায় অনলাইনে ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের ১ম বর্ষে ভর্তি কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০২২ এর ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৮৪তম সভায় সেন্টার ফর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন নামে একটি সমন্বিত সেন্টার প্রতিষ্ঠা করি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেল, ডাটা সেন্টার ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক সেলকে এর আওতাধীন করা হয়। অনলাইনে ক্লাস, ভর্তি, ফরম ফিল-আপ ও পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত কার্যক্রম সহজ ও সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।
আমাদের বার্তা: উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন?
উপাচার্য: আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর প্রথমেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে মনে হয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা ভাববার লোক এখানে কম। এরা অনেক বেশি অবহেলিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। বিভাগ ভেদে প্রায় চার বছরের সেশনজট। তাই আমি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তথা সেশনজট মুক্ত করবার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।
আমাদের বার্তা: সেশনজটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ ছিলো আপনার?
উপাচার্য: সেশনজট মুক্ত করবার বিষয়ে সবচেয়ে কাজে লেগেছে অনলাইন সিস্টেম চালু করা। অনলাইনে ক্লাস, অনাইনে ফরম-ফিলাপ এবং অনলাইনেই পরীক্ষা। এক্ষেত্রে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেশ সহযোগিতা পেয়েছি। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র দুই বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট হিমাগারে পাঠিয়েছি। সেশনজট বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অতীত ইতিহাস। এখন শিক্ষার্থীরা চার বছরের স্নাতক কোর্স চার বছরেই শেষ করতে পারেন।
আমাদের বার্তা: উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
উপাচার্য: আসলে বলতে গেলে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টা নানা কারণে হোঁচট খেয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমেই নানা অসঙ্গতি ছিলো। আমার মনে হয়েছে, এসব অসঙ্গতি দূরীকরণের জন্য উপাচার্য হিসেবে আমার ফুলটাইম ক্যাম্পাসে অবস্থান করা উচিত এবং আমি তাই করছি। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঢাকাতেই যাই না। সব সময় ক্যাম্পাসে থাকি। নিজের স্বল্প মেধার সঙ্গে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। একবারে সবকিছু কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রথমে শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসন করেছি। আমরা এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। একই সঙ্গে গবেষণার দিকে নজর দিচ্ছি। হয়তো জেনে থাকবেন, আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। এর মাধ্যমে চলমান গবেষণার পরিস্থিতির একটা চিত্র উঠে আসবে। এই চিত্র আমাদের পরবর্তী গবেষণা কার্যক্রমের পন্থা ও করণীয় নির্ধারণে সহায়ক হবে।
আমাদের বার্তা: দীর্ঘদিন নতুন কোনো বিভাগ খোলা হয়নি। নতুন বিভাগ খোলার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
উপাচার্য: ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। যুগোপযুগী আরো নতুন কিছু বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে নতুন বিভাগ খোলা সমীচীন হবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সামনে নিয়ে নতুন বিভাগ খোলার কাজ চলছে।
আমাদের বার্তা: ক্লাসরুম ও আবাসন সংকটসহ ভৌত অবকাঠামো সংকট মোকাবিলায় আপনার উদ্যোগ বা পরিকল্পনা কী?
উপাচার্য: এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যমান সকটগুলোর মধ্যে ভৌত অবকাঠামোর সংকট আসলেই প্রকট। এই বিম্ববিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষার হল ছিলো না। আমি দায়িত্ব নিয়ে পরীক্ষার হল নির্মাণ করেছি। বড় কোনো প্রকল্প পাইনি। সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির কারণে আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও আমরা ৮৭৪ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প জমা দিয়েছি। সরকার সদয় হলে আমরা ভৌত অবকাঠামোর এই সংকট নিরসন করতে পারবো।
আমাদের বার্তা: দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ লেগেই আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও এই অভিযোগ দীর্ঘদিনে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনার দর্শন কী?
উপাচার্য: বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান চর্চার স্থান। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম করে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হলে মেধার বিস্তার ঘটবে না, বিকাশ ঘটবে না এবং নতুন জ্ঞানও সৃষ্টি হবে না। তাই আমি মনে করি, শিক্ষক নিয়োগে কোনো ধরনের অনিয়ম একেবারেই উচিত নয়। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার গুরুত্ব দেয়া উচিত। মেধাবীরা শিক্ষকতায় এলে শিক্ষার পরিবেশও ভালো থাকবে।
আমাদের বার্তা: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী? আগামীদিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেমন দেখতে চান? কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব?
উপাচার্য: নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ যেনো হয় মুক্ত জ্ঞান চর্চার উর্বর ভূমি এবং শান্ত-সুষ্ঠু, নিরাপদ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ছেলেমেয়েরা যেনো জ্ঞান আহরণ করতে পারে। তাদের আহরিত জ্ঞানে আলোকিত হবে বিশ্ব। দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ হয়ে উঠবে এই বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এমনটিই আমার প্রত্যাশা। আর আমি মনে করি, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমেই এটির বাস্তবায়ন সম্ভব। এজন্য সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
আমাদের বার্তা: বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে নানা মন্তব্য রয়েছে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা বিস্তারে আপনার পরিকল্পনা কী?
উপাচার্য: বর্তমান বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রসার ঘটছে। এর প্রভাব সামগ্রিকভাবে পরিষ্কার নয় এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করা উচিত। এ ব্যাপারে আমাদের ২৫ বছর মেয়াদি একাডেমিক পরিকল্পনার কাজ চলমান। পর্যায়ক্রমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে।
আমাদের বার্তা: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে। কবে নাগাদ পুনরায় চালু হবে?
উপাচার্য: আমি দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকে বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজটি বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। এই কাজটি পুনরায় চালুর জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এই আলোচনার ফলশ্রুতিতে কাজটি পুনরায় শুরু করার জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয় প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমাদের বার্তা: ২০২৩ এর ১২ অক্টোবর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১৫ বছর পূর্তি হলো। এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন কি সন্তোষজনক বলে মনে করেন? না হলে কেনো?
উপাচার্য: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ বছরের অর্জন সন্তোষজনক নয়। সময় ও অবস্থানগত কারণেই এর আরো উন্নয়ন প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু বিগত সময়ে নানা কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয় বারবার হোঁচট খেয়েছে। করোনার প্রভাব ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশ কিছুটা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। এর আগে তো দেশে অর্থনৈতিক সংকট ছিলো না। তখন যতো সহজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন সম্ভব ছিলো, এখন সেই কাজ এতো সহজ হবে না। তারপরও আমরা শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি একটি মেগাপ্রকল্প জমা দিয়েছি। চেষ্টা করছি, প্রত্যাশা পূরণের।
আমাদের বার্তা: শিক্ষকসহ জনবল সংকটের বিষয়টি একাধিকবার গণমাধ্যমে ওঠে এসেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
উপাচার্য: মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক সংকট নিরসনের বিকল্প নেই। সমসাময়িক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট প্রকট। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকের পদ পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যহত রয়েছে।
আমাদের বার্তা: আমাদের বার্তাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
উপাচার্য: আপনাকেও ধন্যবাদ।