সুইট কর্ন বা মিষ্টি ভুট্টা নামে পরিচিত ভূট্টার একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) গবেষক অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন। উচ্চমানের সুগার, প্রোটিন সমৃদ্ধ ও ক্যান্সার প্রতিরোধ গুণাবলী সম্পন্ন মিষ্টি এই ভুট্টা দেশের প্রোটিন চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তার দাবি। জাতটি গবেষণা প্লটে এবং কৃষক পর্যায়েও চাষ হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্টোমলজি বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের তিনি কোরিয়া থেকে মিষ্টি ভুট্টার মাত্র ১৪ টি ইনব্রিড বীজ এনে প্রবর্তনের জন্য টবে চাষ করেন।
তিনি বলেন, মিষ্টি ভুট্টা সাধারণ কাঁচা বা পুড়িয়ে খাওয়া যায়। দেশের প্রচলিত জাত গুলোর তুলনায় এ জাতের ভুট্টায় চিনি, প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল ও রোগ বালাই নেই বলে কৃষকরা এ জাতের ভুট্টা চাষে আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারেন। ইতোমধ্যে কৃষক পর্যায়ে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইলের গোপালপুর, সুপ্রিম সীড কোম্পানির মাধ্যমে ময়মনসিংহের ত্রিশাল, নীলফামারী, পঞ্চগড়ের কাউয়াপুকুর এলাকায় এবং বিএডিসির মাধ্যমে ঠাকুরগাও এবং মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এলাকায় চাষাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এলাকায় কৃষক পর্যায়েও এ জাতের ভুট্টার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গবেষক অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, উচ্চমানের সুগার সমৃদ্ধ ও ক্যান্সার প্রতিরোধ গুণাবলীর জন্য মিষ্টি ভুট্টা জাপান, কোরিয়া, চীন, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। কোনো রকম প্রক্রিয়া ছাড়াই এটি কাঁচা বা সিদ্ধ করে চিবিয়ে খাওয়া যায়। এছাড়া সালাদ, স্যুপ এবং সবজি হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশে এ মিষ্টি জাতের ভুট্টার আবাদ বাড়ানো হলে শিশু সহ সব বয়সী মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা যাবে।
তিনি বলেন, সাধারণত বীজ রোপণের ১০০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে বিইউ মিষ্টি ভুট্টার মোচার দানা দুধালো দশায় উপনীত হয়। তখন এগুলা বাজারজাত করা যায়। এছাড়া মোচাগুলোর সবুজ খোসা, গাছ, পাতা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা । নতুন উদ্ভাবিত জাতে রোগ বালাই কম থাকায় কোন কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১২ দশমিক ৫ টন হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রচলিত জাতগুলো পশুখাদ্য হিসেবে বেশি প্রচলিত। ‘Zea mays’ প্রজাতির এ জাতটি সুইট কর্ন বা পোল কর্ন নামে পরিচতি।
জানা গেছে, বিইউ মিষ্টি ভুট্টার গাছ গাঢ় সবুজ রঙের। উৎগমন কালে থোবার (টাসেলের) বর্ণ গোলাপী থাকে তবে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে বাদামী রং ধারণ করে। পরিপূর্ণ গাছের উচ্চতা ১৫৫-১৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রতিটি গাছে গড়ে ১০-১২টি পাতা পরিলক্ষিত হয়। একটি গাছ সবুজ বর্ণের খোসা বিশিষ্ট ১-২টি মোচা ধারণ করে। মোচাগুলো গড়ে ১৬দশমিক ৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৪ সেন্টিমিটার বেড় বিশিষ্ট হয়। প্রতি কবে গড়ে ৫৩৭টি সাদা বর্ণের দানা থাকে এবং পরিপক্ক ও শুষ্ক একটি দানার ওজন ২০০ মিলিগ্রাম।
রাসায়নিক উপাদান হিসেবে প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টি ভুট্রায় পানি ৭৫ দশমিক ৯৬ গ্রাম,কার্বহাইড্রেট ১৯ দশমিক ০২ গ্রাম, সুগার ৩ দশমিক ২ গ্রাম,আঁশ ২ দশমিক ৭ গ্রাম,চর্বি ১ দশমিক ১৮ গ্রাম,আমিষ ৩ দশমিক ২ গ্রাম,ভিটামিন সি ৬ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন এ, বি১, বি৩ বিদ্যমান থাকে। মিষ্টি ভুট্রায় আয়রণ, পটাসিয়াম, ম্যাংগানিজ প্রভৃতি খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকে। আঠারোটি অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ এই ভুট্রা রান্না করলে তার অন্তর্গত ফেরুলিক এসিড’র মাত্রাবৃদ্ধি ঘটে- যা মানুষের শরীরে এন্টি ক্যান্সার হিসেবে কাজ করে থাকে। এই ভুট্রার একটি কব (ফল) খাবারের ফলে মানুষের শরীরে ৮৬ কিলোক্যালরি শক্তি সঞ্চিত হয়। দানার পরিপক্কতার সাথে মিষ্টি ভুটৃার সুগার সরল শর্করা স্টার্চে রূপান্তর ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. গিয়াস উদ্দিন মিয়া বলেন, ভুট্টা ফসলের (বৈজ্ঞানিকনাম) প্রজাতি Zea mays। এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ৬টি উপ-প্রজাতি রয়েছে। তাদের ইংরেজি নামগুলো হলো ডেন্ট কর্ন, ফ্লিন্ট কর্ন, পড কর্ন, পপ কর্ন, ফ্লাওয়ার কর্ন এবং সুইট কর্ন। সুইট কর্ন বা মিষ্টি ভুট্টা সুগার কর্ন বা পোল কর্ন নামে পরিচিত। সাধারণ ভুট্টায় স্বতঃষ্ফূর্ত মিউটেশন এর মাধ্যমে মিষ্টি ভুট্টার উৎপত্তি ঘটে। মিষ্টি ভুট্টায় মিল্ক স্টেজে সাধারণ ভুট্টার চেয়ে শতকরা ১৩ তেকে ১৫ ভাগ চিনি বেশি থাকে। তবে সাধারণ ভুট্টা থেকে এর দানার আকারগত কোনো পার্থক্য নেই। বীজবপনের ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে ফসল উত্তোলন করা যায়। অন্যদিকে সাধারণ ভুট্টা উত্তোলন উপযোগী হতে ১১২ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে। বাংলাদেশে চাষকৃত অধিকাংশ ভুট্টা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশুখাদ্য উপযোগী ভুট্রাগুলোর দানা পরিপক্ক হলে (ডেন্ট পর্যায়) মাঠ থেকে তোলা হয় কিন্তু মিষ্টি ভুট্টার ক্ষেত্রে দানাগুলো যখন দুগ্ধসমৃদ্ধ বা মিল্কিং স্টেজে থাকে তখন তোলা হয়। দানার পরিপক্কতার সঙ্গে মিষ্টি ভুট্টার সুগার সরল শর্করা স্টার্চে রূপান্তর ঘটে। এ মিষ্টি ভুট্টার চাষের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভুট্টা খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত ৬৮ টি বিভিন্ন ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। নতুন বিইউ মিষ্টি ভূট্টা জাতটি অবমুক্ত করা হলে দেশের মানুষের পুষ্টিমান তথা পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করা যাবে।