একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল ও জাছিজার রহমান ওরফে খোকা। র্যাবের পৃথক অভিযানে ওয়াহেদকে রাজধানীর উত্তর মান্ডা থেকে র্যাব-৩ এবং খোকাকে মোহাম্মদপুর থেকে র্যাব-২-এর একটি দল গ্রেপ্তার করে।
র্যাব জানায়, তারা ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আত্মগোপনে ছিলেন। অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এছাড়া ছদ্মনাম ব্যবহার করে দীর্ঘদিন তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে নিয়মিত স্থান পরিবর্তন করতেন ওয়াহেদ।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, আব্দুল ওয়াহেদ জামায়াত ইসলামীর গাইবান্ধা সদরের সদস্য সচিব ছিলেন। তার বাবা আব্দুল জব্বারও একই মামলার মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। জব্বার গাইবান্ধা সদর এলাকার শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন। পিতার সঙ্গে মিলে আব্দুল ওয়াহেদ ও তার ভাই জাছিজার রহমান শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালান।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের পয়লা জুন সকালে আসামি আব্দুল ওয়াহেদ, তার পিতা আব্দুল জব্বার মণ্ডল, তার ভাই জাছিজার রহমান মণ্ডল, মোন্তাজ, রঞ্জু মিয়াসহ হানাদার ও রাজাকারের সমন্বয়ে ২০-২৫ জনের একটি দল গাইবান্ধা সদরে বিষ্ণুপুর গ্রামে হিন্দু স¤প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালায়। অম্বিকাচরণ সরকার এবং আব্দুর রউফের পাশাপাশি বাড়িতে আব্দুল জব্বার মণ্ডল দুই ছেলে ওয়াহেদ, জাছিজারসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে। একপর্যায়ে ওয়াহেদ এবং তার বাবা জব্বার মিলে অম্বিকাচরণকে বেধড়ক মারপিট করে। আঘাতের ফলে অম্বিকাচরণ মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকলে তারা তাকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে লুটপাটের মালামাল নিয়ে চলে যায়।
পরে রাজাকার ও পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে আব্দুল ওয়াহেদ তার ভাই জাছিজারসহ আরো বেশ কয়েকজনকে নিয়ে একই গ্রামের দিজেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে। এছাড়া ফুলকুমারী রানী এবং তার ননদ সন্ধ্যারানী সরকারকে পাশবিক নির্যাতন করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। সে ঘটনায় গৃহকর্তা দিজেশচন্দ্র সরকার বাধা দিতে গেলে তাকে তারা গাইবান্ধা আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে এবং তার মরদেহ গুম করে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ওই এলাকায় ৪৫ থেকে ৫০টি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারগুলোকে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ ছিল।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে গাইবান্ধার আদালতে গ্রেপ্তার আব্দুল ওয়াহেদ ও জাছিজার রহমান এবং তাদের বাবাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মামলা করেন আব্দুর রউফ। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করা হয়। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলে আব্দুল ওয়াহেদসহ অন্য আসামিরা ২০১৬ সাল পর্যন্ত জামিনে থাকেন। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে জামিনের মেয়াদ শেষ হলে পরে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হয়। তখন আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।
র্যাব জানায়, তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমাণ হলে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। মামলার রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় দুই আসামি আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়া মারা যান। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মান্ডা এলাকায় ছেলের বাসায় দেখা করতে গেলে ওয়াহেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অন্য এক আসামি মোন্তাজ আলী পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
র্যাব-২ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাছিজার রহমান ওরফে খোকা জানায়, ২০১৬ সাল পর্যন্ত জামিনে থাকার পর আদালত কর্তৃক জামিন নামঞ্জুর হলে তখন তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তিনি বিভিন্ন সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি নিয়মিত বাসা পরিবর্তন করতেন। তার ছেলেরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য তারা নিয়মিত অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন। এভাবেই তিনি পলাতক জীবনযাপন করে আসছিল। গ্রেপ্তার আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান র্যাব কর্মকর্তা।