রোববার (২১ মে) বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ফজলে নূর তাপসের দেওয়া বক্তব্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আইনজীবী ও সুশীল মহলে। ইতিমধ্যে মেয়রের ওই বক্তব্য আপিল বিভাগের নজরে এনেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম। এ নিয়ে মন্তব্যও করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মেয়র তাপস। অনুষ্ঠানে দেওয়া মেয়র তাপসের বক্তব্য একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানে মেয়র তাপস আইনজীবী ও সুশীলদের উপর ক্ষোভ ঝাড়েন।
মেয়র তাপসের সেই বক্তব্য
‘মনটা চায় আবার ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি। যেখানে মুগুর দেয়ার সেটাও জানি। একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম। মশিউজ্জামান (বারের গত নির্বাচনের সাব কমিটির প্রধান)কে আমরা মনে করতাম, ওরে বাবা, কী জানি ফেরেস্তা আসছে। সবচেয়ে বড় চোর হলো মশিউজ্জামান। যে সকল সুশীলরা আমাদেরকে বুদ্ধি দিতে যাবেন সেই সকল সুশীলদের আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেবো।’
‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গঠনের আগেও অনেক বড় বড় আইনজীবী নেতা ছিলেন। কিন্তু যখন এই সংগঠন গঠন করা হয় তখন কিন্তু এইসব বিজ্ঞ, খ্যাতনামা, প্রাজ্ঞ, বড় বড় নেতাদের বাদ দিয়ে আমাদের মতো ছোট আইনজীবীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গঠন করা হয়। সুতরাং এগুলো ভুললে চলবে না।’
‘সবাই খালি ইতিহাস ভুলে যায়। ইতিহাস ভুললে চলবে না। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। কিন্তু ইতিহাস থেকে যারাই শিক্ষা গ্রহণ করে তারাই সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নেয়, নিয়ে চলে। ওরা ৯ বছর চুরি করে ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। আমাদের মাঝে বিভেদ, অনৈক্য, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চুরির মাধ্যমে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে ক্ষমতা দখল করেছিল। তারা দাম্ভিকতা করতো। আমরা এতটা নিচু চিন্তা করতে পারিনি। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয় তারা। এই নির্বাচনের আগের নির্বাচনে আমাদের সেই ভুল ভেঙেছে। আমরা হাতেনাতে ধরেছি তাদের চুরি। হাতেনাতে চুরি ধরাতেই তারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।’
‘মশিউজ্জামানকে আমরা মনে করতাম, ওরে বাবা, কি জানি ফেরেস্তা আসছে। সবচেয়ে বড় চোর হলো মশিউজ্জামান। একটা ভণ্ড। একটা রাজাকারের দালাল। এই মশিউজ্জামানকে আমরা মনে করতাম কী বিশাল এক ফেরেস্তাতুল্য। উনি যা বলবেন তাই হবে। আমাদের ন্যায্য দাবি ছিল। আইনগত দাবি ছিল। আমাদের সম্পাদক প্রার্থী আব্দুন নুর দুলাল তিনি হাতেনাতে তাদের চুরি ধরেছেন। ৬শ’ ব্যালট পেপার গায়েব। ৩১শ’ ভোট পড়েছে। তারা বলে ২৬শ’ ভোট পড়েছে। ৫শ’ ভোট গায়েব। আমরা যখন এগুলো তুলে ধরেছি, কঠোর হয়েছি, সোচ্চার হয়েছি, তখন তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে গেছে। আমরা বলেছি সবার সামনে ব্যালট পেপার এনে গণনা করো। যা ফলাফল হবে আমরা তা মেনে নেবো। সে সময় আমাদের সম্পাদক প্রার্থী আবদুন নুর দুলাল সে অধিকার পাননি। তারা ভোট গণনা বন্ধ করে দিয়ে ৪১ দিনের একটি নাটক সাজালো। প্রতিপক্ষ সম্পাদক প্রার্থীর চোখের ইশারায় ভোট গণনা না করে মশিউজ্জামান চলে গেলেন।’
‘একজন নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের কার্যক্রম সম্পন্ন না করে কোনো ভাবেই যেতে পারে না। কিন্তু তিনি তাই করেছেন। যোগসাজশে তারা এই কার্যক্রম করেছেন। এখন তারা বড় বড় কথা বলেন। এবারের নির্বাচনে তারা যে ন্যক্কারজনক কাজ করেছেন, একজন সভাপতি প্রার্থী যেভাবে ব্যালট ছিনতাইয়ে লিপ্ত হয়েছে তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে কোনো সভাপতি প্রার্থীকে তাও আবার মাথায় টুপি দিয়ে, কতোরকম ভণ্ডামি। মাথায় টুপি দিয়ে ব্যালট ছিনতাই করে। ভণ্ড। ব্যালট চোর। ওরা যে দল করে সেই দল গণতন্ত্র চোর, সংবিধান চোর। ভোট চোর। ৯ বছর চোরেরা লুণ্ঠন করেছে। আমরা আর তা হতে দেবো না। এই চোরদের স্থান আর সুপ্রিম কোর্টে হবে না।’
‘আমাদের মাঝেই আবার কেউ কেউ সুশীল হয়ে যায়। নির্দেশনা দিয়ে রাজনীতি হয় না। ক্যামেরা আছে, অনেক কিছু বলা যাবে না। তা নাহলে একটা গল্প শোনাতাম। যাইহোক এই সুশীল আমাদের দরকার নেই। আমাদের সংগঠনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে কেউ যদি সুশীল হতে চায় তাহলে তাকে সুশীল পর্যায়ে আমরা পৌঁছে দেবো। আমার দরকার ত্যাগী, পরীক্ষিত, আদর্শবান নেতাকর্মী। আমার সুশীল দরকার নেই। আমাকে শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। আমরা যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছি। সেই পাকিস্তান আমল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছি বাঙালি জাতিকে।’
‘আমাদের শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। কে শিক্ষা দিবে আমাদেরকে? সুতরাং কেউ যদি সুশীল হয় আমরা মনে করবো আপনারা ওই পক্ষ। আপানারা আমাদের পক্ষের না। আমি নগর ভবন থেকে শুনি যে আমার নেতাকর্মীদের গায়ে হাত দেয়া হয়। মনটা চায় ইস্তফা দিয়ে আবার ফিরে আসি। একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘সুতরাং এগুলো শুনলে খুব কষ্ট লাগে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতাকর্মীরা আহত হবে, তাদের গায়ে হাত দেবে, এটা কোনোভাবে সহ্য করা যাবে না। মহিলা আইনজীবীদেরকে অপদস্ত করবে, আর আমরা আইনজীবী হিসেবে এখানে বসে থাকবো। এটা হয় না। চোরদেরকে গ্রেপ্তার করে হাজতে ঢোকাতে হবে। এখানে আইনমন্ত্রী আছেন। আমি তার কাছে দাবি করবো, অচিরেই এইসব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হোক। আর না হলে তাদেরকে এই বিচারাঙ্গনে যদি পাওয়া যায় সমুচিত জবাব দেবো। আমরা লিখতেও জানি। এজলাসে বলতেও জানি। আর যেখানে যা মুগুর দরকার, সেটাও জানি। আর যেসকল সুশীলরা আমাদেরকে বুদ্ধি দিতে যাবেন সেই সকল সুশীলদের আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেবো।’
‘১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে আমরা যখন যুদ্ধে ছিলাম তখন আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। আমরা যখন উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় যাচ্ছি, পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে চাইলাম, আমাদেরকে কালিমা দিয়ে অর্থ দিবে না বলল, অপবাদ দিলো যে- পারলে করো দেখি। তোমরা তো গরিব। তোমাদের তো অর্থ নেই। শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় বানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বীর বাঙালি আমরা কারও কাছে মাথা নত করি না। এখন ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদেরকে আবার হুঙ্কার দেয়। তারা ভুলে গেছে জননেত্রী শেখ হাসিনা কারও হুঙ্কারে চলে না।’
‘হুমকি-ধমকিতে, কোনো স্যাংশন, কোনো নিষেধাজ্ঞায় আমরা পিছপা হবো, আমাদেরকে দাবায়া রাখতে পারবা- এই ধারণা অমূলক। একদমই কল্পনাপ্রসূত। কোনো নিষেধাজ্ঞা, কোনো স্যাংশন কোনো কিছুই বাঙালি জাতির এই অগ্রযাত্রা, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই অগ্রযাত্রাকে আর কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না।’
বুধবার (২৪ মে) বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম আনার পর এ বিষয়ে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এসময় একটি দৈনিকে প্রকাশিত মেয়র তাপনের বক্তব্য পড়ে শোনানো হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা একটু দেখি। এখন কোর্টের কাজ করি’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, আদালত থেকে বেরিয়ে এক ব্রিফিংয়ে আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘এটি বড় রকমের অবক্ষয়। এজন্য আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছিলাম। আদালত বলেছেন, তারা দেখবেন। আমরা প্রত্যাশা করছি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এটি দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
হাইকোর্টের বর্ধিত ভবনের সামনে এক ব্রিফিংয়ে আমীর-উল ইসলাম আরও বলেন,‘মেয়র তাপস সুশীল সমাজ সম্পর্কেও কটাক্ষ করে কথা বলেছেন। বারের সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। বিচার বিভাগকে হেয় করেছেন। তার এ বক্তব্য আদালত অবমাননাকর।’