মোবাইল ফোনে আসক্তি ও শিক্ষার ওপর প্রভাব - দৈনিকশিক্ষা

মোবাইল ফোনে আসক্তি ও শিক্ষার ওপর প্রভাব

ড. কে এম আতিকুর রহমান |

ডিজিটাল প্রযুক্তি হিসেবে মোবাইল ফোনের ব্যবহার একটি স্বাভাবিক বিষয় হওয়ার কথা। পরিণত বয়সের মানুষের জন্য এটা স্বাভাবিক একটা মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে শিশু, কিশোর, ও তরুণদের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে অবশ্য এরাই স্মার্ট ফোন বেশি ব্যবহার করছে। ভালো কাজে যে মোবাইল ফোন ব্যবহার হচ্ছে না, তা না। অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন হতে তার শিক্ষার অনেক সমস্যার সমাধান করছে। যেমন-বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীরা হর-হামেশাই ইউটিউব বা ফেসবুকভিত্তিক টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে তাদের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান করছে। কিন্তু ভালো কাজেও যদি মোবাইল ফোনের ব্যবহার অতিরিক্ত হয় তাকে আমরা আসক্তি ছাড়া আর কী বলতে পারি। সমগ্র বিশ্বই মোবাইল ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ আসক্তিতে ভুগছে। শিশু, কিশোর সবাই মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে বেশি সময় ব্যয় করছেন।

এ আসক্তি বর্তমানে তরুণ সমাজের জন্য একটি হুমকি হিসেবে হাজির হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চলাকালীনও ব্যাগের আড়ালে ম্যাসেজের উত্তর দিচ্ছে অনেক ছেলে-মেয়ে। এই ম্যাসেজিংটা খুব দরকার, তা কিন্তু নয়। কিন্তু একাজ হতে তিনি সরে আসতে পারছেন না; কারণ আসক্তি। শিক্ষক তাকে দেখছেন সেদিকেও তার নজর দেয়ার মতো মানসিকতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই কোনো শিক্ষার্থী ওয়াশরুমের কথা বলে শ্রেণিকক্ষের বাইরে যাচ্ছেন। কারণ, ফোন কল রিসিভ করা। যদি জানতে চাওয়া হয়, ফোনটি খুবই ইম্পরটেন্ট ছিল? জি¦, স্যার, মা ফোন দিয়েছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষয়টি অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। ফোন দিয়েছিলেন আসলেই বন্ধু বা বান্ধবী। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল কলেজে আসছেন স্রেফ অধিক সময় ধরে অবাধে ফোন ব্যবহারের জন্য। একইভাবে কোচিং সেন্টারগুলোতেও যাচ্ছেন, তার একটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে ফোনের অবাধ ব্যবহার। ছবি তোলা, ফোনে কথা বলা, ভিডিও করা, ভিডিও দেখা মোবাইল ব্যবহারের প্রধান কিছু আইটেম। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা একটি বড় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কারণ, সেগুলো ফেসবুকে আপলোড দিতে হবে। তরুণদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে নিজের পোস্ট যদি একবার ভাইরাল হয়, তাহলে আমি হিরো। এই হিরো হতে গিয়ে কি না করছেন! আহার-নিদ্রা বাদ দিয়ে ‘ভাইরাল ম্যানিয়া’ রোগে ভুগছেন।

ছেলে-মেয়েদের চিন্তা হচ্ছে পড়ালেখা করলে কত দূরই বা যেতে পারবো। আর একবার যদি ভাইরাল হতে পারি আমি সেলিব্রেটিই শুধুই নয়, আমার আয়-উপার্জন হবে ডলারে। তখন আমাকে কে পায়। আসলে সবই হলো অর্থহীন আবেগের রিহার্সেল। বর্তমান সময়ে ছেলে-মেয়েদের ঘরে রাখতে পারাটা মা-বাবার জন্য এক ধরনের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করতে হয়। বাইরে আসতে পারলেই তারা বন্ধু-বান্ধব মিলে মেতে উঠছেন ‘মোবাইল ম্যানিয়াতে’। ফানি ভিডিও যেমন তারা তৈরি করছেন, আবার অন্যদেরগুলো সবাই মিলে হৈ চৈ করে দেখছেন। মনের অজান্তে ঢুকে পড়ছেন পর্নোগ্রাফিতে। এই যৌন উদ্দীপক কন্টেন্ট গোপনে একা-একা যেমন দেখছেন, আবার গ্রুপে ওরাই সবাই মিলেমিশেও দেখছেন। মাস খানেকের মধ্যেই পর্নো আসক্তিতেই তারা কেবল ডুবে যাচ্ছেন তা-ই নয়; পর্নো আসক্তির নিষ্ঠুর পরিনতি হচ্ছে ‘সেক্সুয়াল এবিউজ’। তরুণ ছেলে-মেয়েদের বিশেষ করে ছেলেদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তারা মোবাইল বা পর্নো আসক্তির নীল ছোবলে আক্রান্ত। এতো সব আসক্তির মাঝে পড়ালেখাটা মনের অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে গৌণ কোনো একটি বিষয়ে। এতো সব আসক্তিতে ব্রেইন বা মন সর্বদা অস্থির থাকে। আবার পিটুইটারি গ্ল্যান্ড ও যৌন হরমোন গ্রন্থির অস্বাভাবিক পরিচালনের কারণের তাদের কার্যক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ফলে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ যেমন আমাদের ছেলে-মেয়েদের হ্রাস পাচ্ছে; তেমনি তারা পড়ালেখাটাকে মনে রাখতে পারা বা আত্মস্থ করতে পারছেন না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। মা-বাবার চাপাচাপিতে পড়ার টেবিলে হয়তো যাচ্ছেন কিন্তু আসল কাজটা হচ্ছে না। কারণ, মোবাইল আসক্তি হতে তিনি তখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারছেন না। অন্যদিকে, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ‘মোবাইলে হৈ চৈ’ এর কথা বার বার মনে পড়ছে। ফেসবুক আড্ডার কথা মনে পড়ছে। কারণ, মোবাইলে বার বার নোটিফিকেশন আসছে ফেসবুক বন্ধুদের। বার বার মনে হচ্ছে ফেসবুকে না জানি কি হয়ে যাচ্ছে। সব মিস করলাম। এমতাবস্থায় বইয়ের পাতার সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে-আবডাল মোবাইলের পাতাও উল্টানো চলছে। মনের অজান্তেই রাত ১২টা বেজে গেছে। পড়ালেখা হয়েছে কেবল ফেসবুক পঠন আর আড্ডা। অনলাইন ক্লাসের নামে ফেসবুকে চলছে জম্পেস আড্ডা। বাবা-মা জানেন ছেলেটা বা মেয়েটা অনলাইন ক্লাসে করছেন। মা-বাবাও ছেলে-মেয়েদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে পারছেন না। কারণ, এমনিতেই সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তারা কথা শুনছেন না। বেশি চাপ দিলে পাছে আত্মহত্যা করে বসেন। ফলে সকল জায়গাতেই রশির বাঁধনটা কেমন যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। আলগা বাঁধন পরিবারে যেমন অস্বস্তি তৈরি করছে; শ্রেণিকক্ষেও তার ব্যতিক্রম কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে রীতিমত মল্ল যুদ্ধে নামতে হচ্ছে। তারপরও ইতিবাচক কিছু হচ্ছে আমার তা মনে হয় না। এমতাবস্থায় শিক্ষকতা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কয়েক বছর আগেও এমন অস্বস্তি কারো মাঝে ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাকরিতে নয়, শিক্ষকতায় বিশ্বাসী ও আনন্দ পাই। কিন্তু কোথায় যেন অস্বস্তি জেঁকে বসেছে। শুধু আমি নই, গোটা দেশের শিক্ষা, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের এই মলিন দশা।

পরীক্ষার হলে লড়াই নয়, রীতিমত যুদ্ধ ছাড়া পরীক্ষার্থীদের মোবাইল হতে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় মোবাইল ফোন বহন বা ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষার্থীরা জামা বা প্যান্টের গোপন জায়গায় মোবাইল বহন করছেন। এমনকি জাঙ্গিয়াতে পর্যন্ত ছেলারা এবং মেয়েরা বোরখার মধ্যে ফোন লুকিয়ে আনছেন (সবাই নয়)। সবাই যে মোবাইল ফোন নকল করার জন্য পরীক্ষার হলে আনছেন, তা কিন্তু নয়। মোবইলটা তার নিকট অনেকটা হেরোইন আসক্তির মতো হয়ে গেছে। মোবাইল ছাড়া কোনো মতেই তারা অন্যকিছু কল্পনাতে আনতে পারছেন না। কখনো জাঙ্গিয়ার মধ্যে, কখনো বা জানালার কার্নিশে, কখনো বা ওয়াশরুমে তা সংরক্ষণ করছেন। হল হতে বের হয়েই মোবাইল স্ক্রিনে চোখ দিয়ে দেখা শুরু হলো। কে কল দিয়েছে কে মেসেজ দিয়েছে; এরপরই শুরু হয় রিপ্লাই। পরীক্ষা কেমন হলো বা পরীক্ষা নিয়ে তেমন কোনো চিন্তায় তাদের মাথায় আসছে না। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে গেলেই বোঝা যাচ্ছে কোনো একটি বাক্যও সঠিকভাবে জেনে বুঝে লেখেনি। কারণ, প্রতিটি বাক্যেই কিছু না কিছু ভুল পাওয়া যাচ্ছে। যেকোনো কারণেই হোক তারা নম্বরটা হয়ত পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষা, জ্ঞান বা আচরণবিদ্যা, যা হবার তাই হচ্ছে।

শিক্ষকরাও কী পিছিয়ে আছেন এই ‘মোবাইল ম্যানিয়াতে’। না, পরিমাণে রকমফের হলেও তারাও এতে কম যাচ্ছেন না। শ্রেণিকক্ষের এক ঘণ্টা পাঠদানকালীন কাজে কমপক্ষে ৪-৫ বার ফোন দিচ্ছেন বা রিসিভ করছেন। এতে সমস্যাটা হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কনসেনট্রেশন ভেঙে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষন শিখনে একাগ্রতা বা মগ্নতা হারাতে বসেছে দিনদিন। আর একটি বিষয়, শিক্ষার্থীরাও মোবাইল ফোনে উৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে, শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধটাও কমে যাচ্ছে। অফিসের প্রধান মেসেজ না দিয়ে সরাসরি কল দেয়ার কারণে পাঠদানরত শিক্ষকও বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করছেন। উন্নত বিশ্বে ‘মেসেজ’ দিয়ে রাখা হয় ক্লাস শেষে তিনি রেসপন্স করবেন। আমদের এখানে ব্যাপারটি উল্টো হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলেও শিক্ষকরা মোবাইলে কথা বলছেন, স্যোসাল মিডিয়া ভিজিট করছেন। ফলে পরীক্ষার্থীরাও সে সুযোগ নিচ্ছেন। মা-বাবা অফিস হতে এসে হয় মোবইলে বা টেলিভিশনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে স্কুলগামী সন্তানরা আরো বেশি সুযোগ পেয়ে যান। এতে কখনো কখনো মোবাইল ব্যবহারে সন্তানরা উৎসাহিত বোধ করেন। এজন্য মা-বাবা শিক্ষকে সংযত হতে হবে যা সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে ভালো ফল দেবে। নীতিনির্ধারক মহল এক্ষেত্রে শিক্ষার চাপটা বাড়িয়ে দেন তাহলে শিক্ষার্থীরা মোবইল ফোনের উপর সময় দিতে কম সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক বা প্রশাসনকে শক্ত হাতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মাঝে ব্যস্ত রাখতে হবে। ফলে মোবাইল ব্যবহারের সময়টা সংকুচিত হবে। পরিবারের মা-বাবাকে সন্তানের সামনে কম মোবাইল ব্যবহার করা উচিৎ। আর ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া ‘মোবাইল ম্যানিয়া’ নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।

লেথক : ড. কে এম আতিকুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033109188079834