পুলিশের হিসাবেই রাজধানী ঢাকায় ছয় হাজারের বেশি ব্যক্তি ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৭৩৭ জন ছিনতাই এবং ৪ হাজার ৪৬১ জন ডাকাতিতে জড়িত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৈরি করা কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্ত রয়েছে। এতে ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িত ব্যক্তিদের তথ্য রয়েছে। সোমবার (৫ জুন) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন নজরুল ইসলাম।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় পুলিশ সূত্র বলছে, ঢাকায় সাধারণত পথ আটকে অস্ত্রের মুখে টাকাপয়সা ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কোনো দলে পাঁচজনের কম থাকলে ছিনতাই আর পাঁচজন বা তার বেশি থাকলে ডাকাতির মামলা দেওয়া হয়ে থাকে। সেভাবেই তথ্যভান্ডারে অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুলিশের বিভাগ হিসেবে সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। সবচেয়ে কম মিরপুর বিভাগে। থানা হিসেবে ছিনতাইকারী ও ডাকাতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ভাটারা, শাহবাগ ও শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় (প্রতিটি থানায় ৩৪ জন করে)। এরপর রয়েছে হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, তেজগাঁও, রমনা, হাতিরঝিল ও উত্তরা পশ্চিম থানা। তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, সবচেয়ে কম ছিনতাইকারী ও ডাকাতের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে উত্তরখান, দক্ষিণখান ও উত্তরা পূর্ব থানায়। এই তিন থানা এলাকার ৬ জন করে মোট ১৮ জন তালিকাভুক্ত হয়েছে।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট থানা ও বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, যেসব এলাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাত বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে, সেসব থানা এলাকার অপরাধীর বৃত্তান্ত তথ্যভান্ডারে যুক্ত হয়েছে বেশি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এলাকাভিত্তিক ছিনতাই বেশি হয় বাড্ডা, ভাটারা, মিরপুর ও পল্লবী এলাকায়। শাহবাগ, মগবাজার, রমনা, মালিবাগ রেলগেট, চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা, গুলিস্তান, ধানমন্ডি, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, নিউমার্কেট, পান্থপথ মোড় ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায়ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।
ছিনতাইকারীরা সাধারণত মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত তৎপর থাকে। তারা ভোরে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশন থেকে বাসামুখী রিকশাযাত্রী অথবা বাসা থেকে স্টেশনমুখী যাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানায়। কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন আড়তমুখী ব্যবসায়ীদেরও লক্ষ্যবস্তু করে ছিনতাইকারীরা। এ ছাড়া নির্জন গলিতে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে পথচারীদের টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। আবার গাড়ি ও মোটরসাইকেলে করে পথ আগলে মানুষের টাকা, মুঠোফোন বা স্বর্ণালংকার কেড়ে নেয় কোনো কোনো চক্র।
এলাকাভেদে ছিনতাইয়ের ধরনেও পার্থক্য আছে। যেমন বিমানবন্দর সড়কে পুলিশ, গোয়েন্দা শাখাসহ (ডিবি) বিভিন্ন সংস্থার পরিচয়ে বেশির ভাগ ছিনতাই হয়। এসব ছিনতাইকারী রাস্তায় ভুয়া তল্লাশিচৌকি (চেকপোস্ট) বসিয়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের গাড়ি থামিয়ে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। এমন অনেক অপরাধী বিভিন্ন সময় ধরাও পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিএমপি এই তথ্যভান্ডার গড়ে তুলেছে সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। তাতে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত ৬ হাজার ১৯৮ জনের ছবিসহ নাম, বয়স, বাবার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, আঙুলের ছাপ, গ্রেপ্তারের তারিখ, তাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা, গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তার নাম-পদবি ও মুঠোফোন নম্বর রয়েছে। এ প্রক্রিয়া যেহেতু চলমান, তাই অপরাধীর সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এসআইভিএস গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যেসব অপরাধী ধরা পড়ছে, তাদের বৃত্তান্ত এসআইভিএসে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে।
যেভাবে কাজে লাগছে এসআইভিএস
বর্তমানে রাজধানীর অনেক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের রহস্যের জট খুলতে এই তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। উদাহরণ হিসেবে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান জানান, গত ১২ মে ভোরে একটি ডাকাত দলের কবলে পড়েন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) নারী কনস্টেবল নার্গিস আক্তার (৩৩)। রিকশা থামিয়ে তাঁর কাছ থেকে সোনার চেইন, নগদ টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় ডাকাতেরা। একই রাতে ধানমন্ডিতে আরেকটি ডাকাতি করে একই চক্র। পরদিন ১৩ মে তেজগাঁও ও বনানী থানা এলাকায় আরও দুটি ডাকাতি করে তারা। ডাকাতির ঘটনায় পল্টন থানায় মামলা করেন নার্গিস আক্তার। তদন্ত করতে গিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরার শতাধিক ফুটেজ থেকে ডাকাত চক্রকে চিহ্নিত করা হয়। পরে এসআইভিএসের সঙ্গে ছবি মিলিয়ে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ১৫ মে মহাখালী থেকে ডাকাত দলের চারজনকে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা-পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ২৭ মার্চ ভোরে মিরপুরের শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহী (৩৯)। এ ঘটনায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ছিনতাই হওয়া মুঠোফোনটি উদ্ধার করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের নাম এসআইভিএসে ছিল।
এই তথ্যভান্ডারের কারণে রাজধানীতে ছিনতাই ও ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেছেন ডিএমপির কর্মকর্তারা। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) বলেন, এসআইভিএসকে কাজে লাগিয়ে গত ঈদুল ফিতরের আগপর্যন্ত তিন মাসে ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্দেহে ১ হাজার ৭৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার ফলে এবারের ঈদুল ফিতরের সময় রাজধানীতে ছিনতাই, ডাকাতিসহ অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।
‘শুধু এসআইভিএসে ছিনতাই কমবে না’
২০০৮ সালে ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার নাইম আহমেদ ‘ছিনতাই প্রতিরোধ নির্দেশিকা’ বের করেছিলেন। ওই নির্দেশিকায় সে সময় ডিএমপির ৩৩ থানার ছিনতাইপ্রবণ ৫৪৪টি জায়গা চিহ্নিত করা হয়।
অপরাধ দমনে অনেক দেশে এসআইভিএসের মতো তথ্যভান্ডার আছে বলে জানান নাইম আহমেদ। তিনি বলেন, অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলা তথ্যভান্ডার অপরাধী শনাক্ত ও ঘটনা প্রতিরোধের একটি মাধ্যম। কেবল এর ওপর নির্ভর করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ, অনেক সময় অপরাধীরা তাদের এলাকা থেকে সরে যায়। তখন এই জায়গায় আবার নতুন অপরাধী যুক্ত হয়ে অপরাধ ঘটায়। তাই পুলিশকে নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে ঘটনা ঘটার আগেই অপরাধপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি সেসব এলাকা টহল ও নজরদারির মধ্যে রেখে অভিযান চালাতে হবে।