রাজনীতি বন্ধ নয়, সংস্কারের পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলো - দৈনিকশিক্ষা

রাজনীতি বন্ধ নয়, সংস্কারের পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলো

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে টানা দেড় দশক অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এ সময়ে বিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের হাজারো অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী এবং ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে পুলিশে দেওয়ার শত শত ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানালেও ছাত্র সংগঠনগুলো এর পক্ষে নয়। তারা বলছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলের কলুষিত ছাত্র রাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন। সব প্রতিষ্ঠানে কার্যকর ও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ প্রয়োজন। সংগঠনগুলো সহাবস্থানের কথা বললেও ছাত্রলীগের বিষয়ে আপত্তি জানাচ্ছে।

সরকার পতনের পরও নিপীড়ন বন্ধ হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে কয়েক বছর আগের নির্যাতনে সম্পৃক্ততার অভিযোগে। চোর অপবাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে ফজলুল হক মুসলিম হলে বর্বর নির্যাতনে খুন করা হয়েছে। 

এদিকে আওয়ামী লীগের পতনের পর দেড় দশক বিতাড়িত অবস্থায় থাকা ছাত্রদল এবং শিবিরের নেতাকর্মী বৈধ বরাদ্দ ছাড়াই হল, ছাত্রাবাসে উঠে পড়েছেন। ছাত্রলীগের দখলে থাকা কক্ষের দখল নিয়েছেন তারা। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটের সভায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির মাধ্যমে রাজনীতির রূপরেখা তৈরি করে ফের অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। 

এসব সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যা দিয়েছে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। এ বিষয়ে সরকার পতনের পর নীরব হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল এবং ছাত্রলীগের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি এতটা পচে গেছে যে, তা সাময়িক বন্ধ রাখা উচিত। দুই-তিন বছর পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে ছাত্র রাজনীতিও উন্মুক্ত হতে পারে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পিটিয়ে, নৃশংসভাবে একজনকে হত্যা করা হয়েছে; এর প্রতিবাদের ভাষা নেই। এ পরিস্থিতিতে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি সাময়িক বন্ধ রাখা যেতে পারে। সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে এটি দোষের নয়। তবে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা উচিত হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ এবং ছাত্রদের অধিকার বজায় রাখতে নিয়মিত ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন দরকার। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবীর খোকন বলেন, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার বিষয়টি মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই প্রতিষ্ঠান কলঙ্কিত হয়েছে বর্বর হত্যায়। এর পেছনের ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করতে হবে। এ ঘটনায় ফ্যাসিবাদের দোসর ও ছাত্রলীগের মদদ এবং অংশগ্রহণ রয়েছে। 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ খুবই ভুল সিদ্ধান্ত এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। আইয়ুব খান তা বন্ধ করেছিল। দেশে যখনই স্বৈরাচারের শাসন থাকে, তারা বলে– রাজনীতি অনিষ্টের মূল। রাজনীতি বেশি হচ্ছে বলে সমস্যা নয়; কম হচ্ছে বলেই সমস্যা। ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যা করল, সেটিই আসল রাজনীতি। সাধারণ ছাত্রদের সুযোগ দেওয়া হলে অপশাসন, লুটেরা ও স্বৈরশাসক স্থান পেতে পারে না। 

বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমান  বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি এক ধরনের; শিক্ষক রাজনীতি আরেক ধরনের। শিক্ষকদের সংগঠন পেশাজীবী। দলীয় লেজুড়বৃত্তি নেই, তবে আদর্শিক মিল রয়েছে। শিক্ষক সংগঠন বন্ধের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা পর্যন্ত কিছু বলব না। লুৎফর রহমানও ছাত্র রাজনীতির অধঃপতনের জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, গত ১৭ বছর এক ধরনের রাজনীতি ছিল, তা একটি দলের তাঁবেদারি আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর কর্তৃত্ব জাহির। ’৫২, ’৬৯, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের ছাত্র রাজনীতি তেমন নয়। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিকে খারাপ জায়গায় নিয়েছে, তাদের রাজনীতি বন্ধ হওয়া এক রকম। তবে সাধারণ অর্থে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে নই। রাজনীতি লেজুড়বৃত্তির নয়, শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়া উচিত মন্তব্য করে লুৎফর রহমান বলেছেন, শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমের কথা বলতে গিয়ে সিন্ডিকেট, সিনেট থেকে ওয়াকআউট করেছি। ছাত্রদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করি। এই আদর্শে যে দল থাকে, তাদের সমর্থন করি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আবদুল কাদের বলেন, রাজনীতি করা-না করা সাংবিধানিক অধিকার। সাংবিধানিক অধিকার নিষিদ্ধ হলে কালকে হাইকোর্টের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা যাবে। ছাত্র রাজনীতি বলতে এখন দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুম কালচার বা সরকারের তাঁবেদারি বোঝায়। ক্যাম্পাসে সীমিত আকারে রাজনীতি থাকতে পারে অভিমত দিয়ে আবদুল কাদের বলেছেন, আবাসিক হলে কোনো কমিটি থাকবে না, রাজনীতি থাকবে না, ‘ভাই কালচার’ থাকবে না। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয়ে কমিশন গঠন করে নতুন ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা আনা হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দরকার। ছাত্র সংসদ থাকলে সংকট থাকবে না।
 
শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম বলেছেন, শিক্ষার্থীরা গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের কারণে ছাত্র রাজনীতির সোনালি দিন দেখেনি। তাই রাজনীতি বন্ধের কথা বলছে। বন্ধ নয়; ছাত্র রাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, তাতে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা রয়েছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। শিবির সহাবস্থানের রাজনীতি চায় বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির সভাপতি। সেই সহাবস্থান ভাবনায় ছাত্রলীগ আছে কিনা– প্রশ্নে মঞ্জুরুল ইসলাম বলেছেন, তাদের যে ভূমিকা ছিল, এর পরও তারা থাকতে পারবে কিনা– জনগণ এ সিদ্ধান্ত নেবে।
 
ছাত্র ফেডারেশনের (গণসংহতি আন্দোলন) কেন্দ্রীয় সভাপতি মশিউর রহমান খান বলেন, বর্তমান সিন্ডিকেট অভ্যুত্থান-পূর্ব অন্যায় শাসনের পক্ষে নিপীড়কের ভূমিকায় ছিল। রাজনীতি বন্ধের মতো ফ্যাসিবাদ জারি রাখলে ‘মব কালচার’ তৈরি হবে। দ্রুত ডাকসু নির্বাচনে যেতে হবে। ছাত্রলীগের মতো কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা যেন তৈরি না হয়, সে জন্য সংস্কার এনে হলগুলোতে প্রশাসনের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকের মতাদর্শ বিবেচনায় নিয়ে সহাবস্থান সৃষ্টিতে প্রশাসনের কাজ করা উচিত। 
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত মতের জায়গা; নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা। ছাত্র রাজনীতি নয় বরং সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। বিরাজনীতিকীকরণ থেকে প্রশাসনকে ফিরে আসতে হবে এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা এবং সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ যৌথ বিবৃতিতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। 

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028870105743408