দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: হিন্দুধর্মের মহান সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় এর জন্মদিন আজ। তিনি ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে পশ্চিম বাংলার রাধানগর গ্রামের এক রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আঠারো শতকের ভারতের গতানুগতিক সনাতনী শিক্ষা লাভ করেন। তার বাল্যাকালে ও প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দি ও তার মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রাচ্যভাষা, যেমন সংস্কৃত, আরবি ও ফারসিতে উল্লেখযোগ্য ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করেন এবং মুসলমান পণ্ডিত ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন।
রামমোহনের প্রথম দিকের রচনাগুলো ছিলো আরবি ও ফারসি ভাষায়। মনযারাতুল্ আদিয়ান শীর্ষক তার প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থটি বিভিন্ন ধর্মের আলোচনায় নিবেদিত। এটি কখনো ছাপা হয়নি ও পরে হারিয়ে যায়। আরবি ভাষায় শিরোনাম ও মুখবন্ধ সম্বলিত ফারসি ভাষায় লিখিত তার গবেষণামূলক পুস্তিকা তুহফাত-উল-মুওয়াহিদ্দীন-এ রামমোহন শুধু এ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করেছেন।
অল্প বয়সে রামমোহন তার নিজস্ব স্বাধীন সম্পত্তির মালিক হন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জড়িয়ে পড়েন। তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বুদ্ধিগত বন্ধন-মুক্ত অর্জনের সহায়ক হয়। রামমোহন ওই সময়কার কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ও সদর দেওয়ানি আদালতের সঙ্গে যুক্ত নেতৃস্থানীয় ভারতীয় পণ্ডিতদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি ইউরোপীয় কর্মকর্তা ও বণিকদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন, যাদের অনেকেই উদারবাদী চিন্তা ও ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রামমোহন ইতিপূর্বেই ইংরেজি শিখেছিলেন এবং তার ইংরেজ বন্ধুদের সান্নিধ্যে এসে সমকালীন ইউরোপীয় চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন।
১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন এবং তার জীবনের নতুন এক পর্ব শুরু হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তার জীবনকে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশে উৎসর্গ করবেন। তার কলকাতা পৌঁছার এক বছরের মধ্যেই সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আত্মীয় সভা নামে একটি একান্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর সদস্যবৃন্দ ওই সময়কার ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনার জন্য তার বাসায় নিয়মিত মিলিত হতেন। রামমোহন তার চার পাশে ছোট কিন্তু প্রভাবশালী একটি বন্ধু-মহল গড়ে তুলতে সমর্থ হন, যাদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় উভয়ই। তার ঘনিষ্ঠ ভারতীয় বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তারা দুজন ছিলেন নেতৃস্থানীয় ও সম্পদশালী জমিদার, যাদের ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্বন্ধ ছিলো।
রামমোহন হিন্দু সংস্কারের এক মহান যুগের সূত্রপাত করেন। তিনি সতীদাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যা ১৮২৯ খ্র্রিষ্টাব্দে বিশেষ আইনের মাধ্যমে এ প্রথা বন্ধ করতে সরকারকে প্রভাবিত করেন। রামমোহন প্রতিমা পূজাকেও দৃঢ়ভাবে বর্জন করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দুধর্ম এক সর্বজনীন ঈশ্বরের পূজা করতে নির্দেশ দেয়।
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে খেতাবসর্বস্ব মুগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তার পক্ষে ব্রিটিশ রাজ ও পার্লামেন্টে ওকালতি করার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান। ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সমাজের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফ্রান্সও সফর করেন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিস্টল ভ্রমণকালে তিনি রোগাক্রান্ত হন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান।