রূপান্তরিত শিক্ষা ও শিক্ষক - দৈনিকশিক্ষা

রূপান্তরিত শিক্ষা ও শিক্ষক

মো. আমিনুল হক |
আজ ৫ অক্টোবর ২০২৩ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সারা বিশ্বে প্রায় ১শ’টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। দিনটি শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়। এবার বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘পরিবর্তনশীল গতিপথ রূপান্তরিত শিক্ষা’।
 
শিক্ষা বলতে বোঝায় কোনো বিশেষ জ্ঞান, কৌশল বা দক্ষতা অর্জন। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার্থীদের সব রকম সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ হলো শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক জীবনের বিকাশ সাধিত হয়। রূপান্তরমূলক শিক্ষা হলো এক ধরণের অভিজ্ঞতা, যা কোনো ব্যক্তির মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। এক্ষেত্রে চিন্তা, অনুভূতি এবং মৌলিক কর্মক্ষেত্রে একটি গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। এটি মন এবং হৃদয়ের শিক্ষা। রূপান্তরিত শিক্ষা স্থানীয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনয়নের ক্ষেত্রে একটি কৌশল হিসেবে কাজ করে এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকদের শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলে। ফলে ব্যক্তিবর্গ দায়িত্ব নিতে শিখে থাকে।
 
শিক্ষাদান একটি জটিল ও কঠিন কাজ। যিনি এ কাজটি করেন তিনিই শিক্ষক। শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষাদান চলতে পারে না। শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। একজন আদর্শ শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব শিক্ষার কাজ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকই শিক্ষা কর্মের মূল উৎস। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে আধুনিককালে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তন বা রূপান্তর আসছে। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু ইত্যাদির মধ্যে ব্যাপক রূপান্তর ঘটছে। বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের এসব পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিয়ে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকের। তাই শিক্ষককে করতে হয় জ্ঞানের সাধনা এবং আয়ত্ব করতে হয় শিক্ষাদানের সঠিক কলাকৌশল। 
 
বলা হয়ে থাকে ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’। যে জাতি শিক্ষায় যতো উন্নত, সেই জাতি সামাজিক ও আর্থিকভাবেও ততো উন্নত। তারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়। আমরা যদি শিল্প বিল্পবের কথা বলি তবে দেখতে পাই এর মূলে রয়েছে পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত শিক্ষা। প্রথম শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয় ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের মাধ্যমে। পানি ও বাষ্পের ব্যবহার করে করা হয় উৎপাদন বৃদ্ধি। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব ঘটে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যুতের আবিষ্কারের ফলে। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহারের ফলে গণহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ঘটে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রেডিও আবিষ্কারের ফলে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। সবশেষ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ঘটে যায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এমন কিছু, যা আগে দেখা যায়নি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, আমাদের দেশের টেন মিনিট স্কুল, রকমারী ডট কম, বিকাশ, রকেট এগুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফল। এসব বিল্পবের মূলে রয়েছে শিক্ষা। যার নেতৃত্বে থাকেন শিক্ষক। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) এর প্রভাবে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থার উপর। শিক্ষকদের চেষ্টা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ফলে গতাণুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে অনলাইন পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পরিবর্তন ও রূপান্তরের এই কাজটি কিন্তু করে যাচ্ছেন শিক্ষকগণ। 

 

 
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ঘরে উঠাতেও শিক্ষকগণ অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পূর্বের যে কোনো বিপ্লবের তুলনায় দ্রুততার সাথে বিস্তৃত হচ্ছে। এমন অভূতপূর্ব রূপান্তর মানবজাতি পূর্বে কখনো দেখেনি। শুধু অর্থনীতিই নয়, মানুষের চিন্তা-ভাবনা, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুর ওপরই এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। এমন সব আবিষ্কার হয়েছে, যা আগে কখনো মানুষের ধারণাতেও আসেনি। ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে ন্যানোপদার্থ, যা লোহা থেকে ২শ’ গুণ বেশি শক্ত কিন্তু মাপের দিক থেকে মানুষের চুলের ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ। খুব শীঘ্রই ত্রিমাত্রিক ছাপাখানায় মানব যকৃৎ তৈরি হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে রূপান্তরিত এই শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন শিক্ষক। 
 
বর্তমানে প্রযুক্তি জগতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো চ্যাটজিপিটি। অর্থাৎ চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার। এটি এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গঠিত। ইন্টারনেটে থাকা প্রচুর লেখা বা ডেটা দিয়ে একে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাকে প্রশ্ন করা হলে লিখিতভাবে মানুষের ন্যায় উত্তর দিতে পারে। যে কোনো কাজের জন্য সাহায্য নেয়া যায়। যেমন- ছাত্রের পরীক্ষা প্রস্তুতির বিষয়ে সাহায্য চাইলে সাহায্য করবে। কোনো কঠিন বিষয় বুঝতে না পারলে সে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিবে। এতে রয়েছে কিছু আকর্ষণীয় ফিচার। যেমন- নিবন্ধ লেখা, গল্প লেখা, গানের লিরিকস লেখা, কবিতা লেখা ইত্যাদি। দুর্ঘটনায় পড়ে যদি জানতে চাওয়া হয় কিভাবে রক্তপাত বন্ধ হবে, তারও সমাধান দেয় এটি। চ্যাটজিপিটির সাথে গেমও খেলা যায়।
 
পিডব্লিউসি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মতে, স্বয়ংক্রিয়করণ ও রোবটিক্সের প্রভাবে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে ৮০ কোটি মানুষের চাকরি চলে যাবে। আবার নতুনভাবে ১শ’ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানভিত্তিক জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বর্তমান ও আগামীর নাগরিকদের জন্য ১০টি দক্ষতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো- জটিল সমস্যা সমাধান ক্ষমতা, তুরীয় চিন্তা, সৃজনশীলতা, জনব্যবস্থাপনা, অন্যদের সাথে কাজের সমন্বয়, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেবা প্রদানের মানসিকতা, দর-কষাকষি এবং চিন্তার স্বচ্ছতা। 
 
পরিবর্তনশীল ও রূপান্তরমূলক শিক্ষার সুফল পেতে হলে অবশ্যই শিক্ষকের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। তাকে যেমন প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে হবে, তেমনি তার মৌলিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অধ্যায় ২৫ (শিক্ষকের মর্যাদা, অধিকার, দায়িত্ব) এ বর্ণিত সুবিধাদি অদ্যাবধি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: 
 
(১) শিক্ষকদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।
(২) শিক্ষার সকল পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জেষ্ঠ্যতা এবং শিক্ষার সকল পর্যায়ে তাদের শিক্ষকতার মান বিবেচনায় আনা হবে।
(৩) মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচিত শিক্ষকদের শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদায়ন করা হবে এবং তাদের পদোন্নতির সুযোগ থাকবে। 
 
২৭ নং অধ্যায় (শিক্ষা প্রশাসন) এ বলা হয়েছে- 
(১) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার নিরিখে প্রতিযোগিতামূলকভাবে উচ্চতর পদে নিয়োগ প্রদান করা হবে। যেমন- প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক হতে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক হতে অধ্যাপক পদে।
(২) এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণের চাকরি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় বদলিযোগ্য হবে। 
পরিবর্তিত প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে এমন জনগোষ্ঠী প্রয়োজন, যারা এর উপযোগী, যাদের জ্ঞানার্জন ও প্রয়োগের সক্ষমতা রয়েছে। এর মূল চালিকা শক্তি হলেন শিক্ষক। তাই শিক্ষকগণের যৌক্তিক দাবিসমূহ যতো দ্রুত সম্ভব পূরণ করা হলে শিক্ষকগণ অধিক প্রেরণাসহ দায়িত্ব পালন করবে। এতে রূপান্তরিত শিক্ষাব্যবস্থার সুফল পাওয়া যাবে। ফলশ্রুতিতে আমরা নির্ধারিত সময়ে মানবিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করতে পারবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। 
 
লেখকঃ অধ্যক্ষ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ, ঢাকা

 

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027449131011963