নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) তিন কর্মকর্তা ও দুই অফিস সহকারীসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার হয়েছে। আরও অন্তত ১৫ জন রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তকারীরা চাচ্ছেন আপাতত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনাটি সুরাহা করতে। ফাঁস হওয়া ওই প্রশ্নে দেড় শতাধিক প্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলে ধারণা তদন্তকারীদের। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।
গত ৫ জুলাই রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের দশম গ্রেডের উপসহকারী প্রকৌশলীর ৫১৬টি পদের লিখিত (এমসিকিউ) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগ ওঠে, ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এর পরই বেরিয়ে আসে এই চক্রটি শুধু রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই নয়, গত কয়েক বছরে বিসিএসসহ বিভিন্ন ধরনের অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। এ ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
শুক্রবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, প্রশ্নফাঁস বা তা ব্যবহার করে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। প্রশ্নফাঁসে জড়িত অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছিল, তাদের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর পরই তাদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির আরেক কর্মকর্তা বলেন, আপাতত রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর পর এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে অন্য পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার যে তথ্য আছে, সে বিষয়েও তদন্ত করা হবে। এটা দীর্ঘ সময়ের একটা কাজ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে অন্তত ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রশ্নফাঁসের মূলহোতা আবেদ আলীসহ তিনজন রেলওয়ের পরীক্ষায় কতজনের কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রি করেছেন তা স্বীকার করেছেন। তারা মূলত প্রশ্নপত্র বিক্রির জন্য চুক্তি করা পরীক্ষার্থীদের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র তুলে দিতেন না। পরীক্ষার এক বা দুই রাত আগে নিজেদের নির্দিষ্ট ভাড়া বাসায় চুক্তি করা প্রার্থীদের নিয়ে এসে প্রশ্নপত্রের উত্তর মুখস্ত করাতেন। চক্রটির ভাষায়, এই ধরনের বাসাকে ‘বুথ’ বলা হয়। আবেদ আলীর জবানবন্দি ও জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে, তার সাভারের রেডিও কলোনিতে তৈরি করা বুথে ৫০ থেকে ৬০ জন চাকরিপ্রার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়েছিলেন। রেলওয়ের প্রশ্নফাঁসে সরাসরি যুক্ত পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুলের বন্ধু পুরানা পল্টনের পানির ফিল্টার ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন এবং তার ভাই সায়েম হোসেনও এ চক্রে জড়িয়ে গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
সাখাওয়াত জবানবন্দিতে বলেছেন, পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোডের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার ব্যবসায়িক পণ্যের গুদাম রয়েছে। বন্ধু সাজেদুলের মাধ্যমে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৪ জন প্রার্থীকে পরীক্ষার আগের রাতে ওই গুদামঘরে রাখা হয়। রাতভর চাকরিপ্রার্থীদের উত্তর মুখস্থ করানোর পর তারা সেখান থেকেই পরীক্ষা দিতে যান।
তা ছাড়া পিএসসির আরেক অফিস সহকারী (ডেসপাস রাইডার) খলিলুর রহমান বলেছেন, একই পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তিনি চাকরিপ্রত্যাশী ৫০ থেকে ৬০ জনের কাছে বিক্রি করেছেন।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ওই তিনজনের জবানবন্দিতে উঠে আসে, অন্তত ১৬৪ জনের কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রির জন্য চুক্তি করা হয়। তাদের অনেকের নাম-ঠিকানাও পাওয়া গেছে। এখন গ্রেপ্তার আসামিরা পরীক্ষার আগের রাতে যে বুথে রাখার কথা বলেছে, আদৌ পরীক্ষার্থীদের সেই বুথে নেওয়া হয়েছিল কি না, চক্রের সঙ্গে চুক্তি করা প্রার্থীদের কোন মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল, সেসব বিষয়ে তদন্ত করে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রমাণ মিললে এই প্রার্থীদেরও আইনের আওতায় নেওয়া হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের পিএসসির আরেক সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায় পলাতক।
এ ছাড়া পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর, জাহাঙ্গীর আলমসহ কয়েকজন কারাগারে রয়েছেন। নিখিলকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে থাকা অন্য ব্যক্তিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের জন্য চুক্তি করা প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে।