২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার, টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও প্রথম থেকেই এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে, টেকসই ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযানের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে উপসংহারে পৌঁছে যে, সামরিক অভিযানে ‘গণহত্যামূলক কাজ’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। জাতিসংঘ এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ' হিসেবে বর্ণনা করে।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাব করেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে বাংলাদেশে সফর করেন। রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই জাতিসংঘ এবং এর অধীন সংস্থাগুলো জরুরি সহায়তার জন্য কক্সবাজারে কাজ করছে এবং বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতাও করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংকট সমাধানে নির্দেশনা চলমান রেখেছেন। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও, স্থানীয় এনজিওগুলো তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরলস কাজ করছে।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দফা দাবি তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস চলমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মিয়ানমারের মানবাধিকার-বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহিলি এবং পৃথিবীর ক্ষমতাধর সব দেশকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দায়িত্ব পালন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষমূলক উত্তেজনা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৯৩টি সদস্য-রাষ্ট্রের মধ্যে প্রস্তাবটির পক্ষে ১৩৪টি দেশ, বিপক্ষে ৯টি দেশ ভোট দেয় এবং ২৮টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি' শিরোনামে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এটা ছিল চতুর্থবারের মতো এক ধরনের প্রস্তাব। ওআইসি এবং ইইউ যৌথভাবে এই প্রস্তাব আনে। প্রস্তাবের পক্ষে ১৩২ দেশ ও বিপক্ষে ৯টি দেশ ভোট দেয় এবং ৩১ দেশ ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকা’র মধ্য দিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, কম্বোডিয়া, বেলারুশ, জিম্বাবুয়ে ও ভিয়েতনাম এই নয়টি দেশ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। এই প্রস্তাবে রাখাইনে একটা গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা, তাঁদের নাগরিকত্বসহ সব ধরনের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে সম্মত হয়, তাঁর জন্য একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা-এই তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারির পরে চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় নিয়ে ওআইসি ও ইইউ’র আনা ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি' শীর্ষক একটি প্রস্তাব ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। ই ইউ ও ওআইসিভুক্ত দেশগুলোসহ মোট ১০৭টি দেশ এই প্রস্তাব উত্থাপন করে। আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশ, ভারত এবং চীন এখানে অনুপস্থিত ছিল। জাতিসংঘে এই প্রথম বারের মত সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা বিষয়ক রেজুলেশন গৃহীত হয়, যা এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন৷ জাতিসংঘে গৃহীত এই প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা, বাংলাদেশের সাথে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্তগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ জাতিসংঘের সকল মানবাধিকার কার্যক্রমকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই প্রস্তাবটি ছিল রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের এ পর্যন্ত নেয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘে এ ধরনের প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার পর চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ অনেকে প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তবে এবার তারা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করে। এতে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। এই প্রস্তাবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত নিয়োগকে স্বাগত জানানো হয়েছে এবং মিয়ানমারে তার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টায় মিয়ানমার এবং ইউএনএইচসিআর এবং ইউএনডিপির মধ্যে স্বাক্ষরিত এমওইউ পুনঃনবায়ন এবং কার্যকর বাস্তবায়নের আহবান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এ বছর মে মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে জানান যে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য মিয়ানমারে যে সব দেশের প্রভাব রয়েছে তাদের নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করে রাখাইনে ফিরে যেতে চায়, তবে রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি নিরাপদ না হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠিক হবে না বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত। হাইকমিশনার রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন এবং জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমার নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। গত ২১ ডিসেম্বর পাস হওয়া প্রস্তাবে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি অং সান সুচিসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং এর পক্ষে ১২টি দেশ ভোট দেয় এবং বিপক্ষে কোনো দেশ ভোট দেয়নি। মিয়ানমারের সংকট মোকাবিলা করার বিষয়ে জাতিসংঘের মতপার্থক্য দীর্ঘদিনের। এতদিন যাবত মিয়ানমারের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে কোনো কঠোর পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছিল। তিন মাস ধরে আলোচনা শেষে বুধবার ১২-০ ভোটে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। ভোটাভুটি পর্বে প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো সদস্য ভোট দেয়নি বা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী কোনো সদস্য ভেটো দেয়নি।১৫ সদস্য দেশের মধ্যে চীন, ভারত ও রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল।
প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করা হয়। পরিষদ রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের নিমিত্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট এবং এর টেকসই সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে ৭৪ বছরে প্রথমবারের মতো প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এ সমস্যার সমাধানে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত পাঁচ দফা ঐকমত্যের দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং এর বাস্তবায়নে জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হবে কি না, সে বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব ও মিয়ানমার–বিষয়ক বিশেষ দূতকে আসছে ১৫ মার্চের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পেশ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। প্রস্তাবে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলার বিষয়টিও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়। নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি অনুমোদন করায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মিত কার্যকলাপের অংশ হয়ে গেল। একই সাথে এটি রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের এতদসংক্রান্ত অব্যাহত প্রচেষ্টাকে আরো শক্তিশালী ও ত্বরান্বিত করবে। এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থনের সুদৃঢ় ইঙ্গিত।
গত ছয় বছরে রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবনাগুলোর ফলাফলের ধারাবাহিকতা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের গুরুত্বের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। নেতিবাচক মনোভাব পোষণকারী সদস্য রাষ্ট্রগুলো এখন তাদের মত পরিবর্তন করে গৃহীত প্রস্তাবনার পক্ষে মত দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই প্রস্তাব বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব এবং চলমান পদক্ষেপের বিষয়ে সবাইকে অবহিত রাখার বাংলাদেশের নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। মিয়ানমারের সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পথ সুগম করতে এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানকে ত্বরান্বিত করুক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ