শহরটা কারো বাপের না। তার মানে সবার। কিন্তু শহরের সব সম্পদের সবচেয়ে বড় দখলদার সরকার বা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও পাল্লা দিয়ে দখলের মচ্ছবে মাতে। এসব প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে শহরের নদী, জলাভূমি, উদ্যানকে কংক্রিটের চাকচিক্যে পরিণত করে। তাদের কারণে তৈরি হয় নানামুখী বিড়ম্বনা। পদে পদে লঙ্ঘিত হয় ন্যায্যতা। বাড়ে বৈষম্য। কিন্তু, এসব সম্পদে তো জনসাধারণের অবারিত অধিকার। উপরন্তু, নিজের আবাসনের ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়ে প্রতিটি মানুষই নগরের উন্নয়নে সরাসরি অংশীদার। তাই যে জায়গাটাতে যারা থাকবে, সে জায়গায় উন্নতির পরিকল্পনাটা তো তাদেরকে নিয়েই করতে হবে। এসব কারণে নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে ন্যায্য নগর ইশতেহার প্রকাশের প্রস্তুতি চূড়ান্ত। আগামী ১৯ ও ২০ নভেম্বর প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ মিলনায়তনে এই ইশতেহারের বিশেষ অধিবেশন বসবে। কী থাকবে তাতে? ন্যায্য নগরটা আসলে কী? ঢাকার মতো চরম অপরিকল্পিত শহরকে কি ন্যায্য নগরে রূপ দেয়া সম্ভব? এসব জানতে সম্প্রতি ইশতেহার তৈরির অন্যতম দুই সংগঠক মোহাম্মদ এজাজ ও ড. ইফাদুল হক এর মুখোমুখি হয় দৈনিক আমাদের বার্তা। এ সময় তারা বলেন, যার বা যাদের জন্য ন্যায্যতা, তার বা তাদের কাছ থেকেই শুনতে হবে যে ন্যায্যতাটা আসলে কি, কী ধরনের শহর তারা চায়? কারণ প্ল্যানিং ও গভর্ন্যান্স এ দুটোতেই একটা ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিস থাকা জরুরি।
আমাদের বার্তা: ন্যায্য নগর আসলে কি
মোহাম্মদ এজাজ: ন্যায্য নগর এমন একটা ন্যারেটিভ যার ভিতটা জুলাই অভ্যুত্থান গড়ে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, গ্রাম থেকে মানুষ যখন শহরে আসে সে তো শুধু রিজিকের জন্য আসে না। তারা অনেক কারণ এখানে আসে। তারপর হয়তো শহরে থেকে যায়। বাংলাদেশকে আমরা যদি নতুন করে গঠনের চেষ্টা করি, তাহলে এসব কারণ বুঝতে হবে।
বাংলাদেশে এখন ৪০ থেকে ৪৫ পার্সেন্ট মানুষ শহরে বসবাস করে। ২০৫০ নাগাদ প্রায় ৭০ পার্সেন্ট জনগণ শহরের অধিবাসী হবে। তাই নগরকে যদি মাথায় না রেখে আমরা নতুন রাষ্ট্র গঠন করি তাহলে একটা বড় বিষয় মিস করে যাব। এ কারণে নগরায়ণটা কতটুকু ফেয়ার হবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত ৫০ বছরে আমরা বাংলাদেশে যতগুলো শহরের প্ল্যান করেছি, শুধু ল্যান্ড ইউজড প্ল্যানিং হয়েছে। এই প্লানিংয়ের রেজাল্ট তো আমরা দেখেছি। মানুষ বিভিন্ন ভ্যাকেশনে পাগল হয়ে যায় শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার জন্য। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখছি, অনেকেই শহর ছেড়ে আর গ্রামে যেতে চাইছেন না। এর কারণ, তার গ্রামটাও আর আগের মতো নেই। তারা এখন শহরে স্থায়ী হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শহর তো তাদেরকে স্থায়ী হিসেবে নেয়নি। তাহলে এই শহরের মধ্যে আমরা ন্যায্যতাটা কিভাবে পাবো? এই শহরের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, ট্রান্সপোর্ট –এসব বাদ দিয়ে যদি শুধু ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে এক ধরনের পার্শিয়ালটি হয়ে যায়।
তাছাড়া গত ৫৩ বছরে আমরা বাংলাদেশে যত শহর তৈরি করেছি, সেগুলো কোনো না কোনো ইকোলজিকে বেইজ করে হয়েছে। কোনো নদীর পাড়ে শহর হয়েছে, পাহাড়ের মাঝে শহর হয়েছে অথবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টারগুলোর পাশে শহর হয়েছে। কিন্তু কোনো প্ল্যানিং কি আমরা স্থানীয় ইকোলজিকে বেইজ করে করতে পেরেছি? পারিনি। তাই এসব শহরে সবাইকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
সুতরাং, একটা ফেয়ার সিটি আমাদের মাথার মধ্যে যদি থাকে, একটি ন্যায্য সমাজ, একটি রাষ্ট্র, একটি ন্যায্য নগর যদি আমরা করতে চাই, সেটা ডিফাইন করবে কে? গত ৫৩ বছরে তো আমরা ঘরে বসে প্ল্যান করেছি। এখন নতুন একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। জনগণের অভ্যুত্থান। সুতরাং জনগণই ঠিক করবে তাদের নগর কেমন হবে। আমরা উপর থেকে আর কোনো ধরনের প্ল্যানিং চাই না।
আমাদের বার্তা: কিন্তু, এই বিষয়টিকে আপনারা ইশতেহার কেনো বলছেন?
মোহাম্মদ এজাজ: কারণ, যেহেতু আমরা প্রাথমিকভাবে কনস্টিটিউশন এর কাছে যাব। এর প্রস্তুতি হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের মতামত আমরা নিয়েছি। তারা নিজেদের শহরটাকে কিভাবে দেখতে চায় তা জানার চেষ্টা করেছি। তাদের মধ্য থেকে আড়াইশ জনকে আমরা ঢাকায় নিয়ে আসবো। কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, একাডেমিশিয়ান থেকে শুরু করে সকলের সঙ্গে তারা দুদিনব্যাপী ব্রেন স্টর্মিং করবে। তারপরে তাদের ধারণাটা আরেকটু ডিপ হবে। এটা ধরে তারা আরেকটি ইশতেহার করবে। ভাবনাগুলো চূড়ান্ত রূপ নিলে আমরা রাষ্ট্র গঠনের কনস্টিটিউশনাল যে প্রক্রিয়া আছে, সেখানে এটা প্রেজেন্ট করতে চাই।
আমাদের বার্তা: এই যে বলছেন জনগণের অংশগ্রহণে উন্নয়ন- কিভাবে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে?
মোহাম্মদ এজাজ: যে হাজার হাজার মানুষের ওপিনিয়ন আমরা পেয়েছি, সেগুলো থেকে সাতটি থিমেটিক এরিয়া বাছাই করেছি। এসব থিমেটিক এরিয়া ধরে ঢাকা শহরের যেসব বাসিন্দা আছেন, তাদের মধ্যে আমাদের সঙ্গে পঞ্চায়েত কমিটির লোকজন থাকবেন, দলিত যারা আছেন তারা থাকবেন, ট্রান্সপোর্ট নিয়ে যারা কাজ করেন তারা থাকবেন, ফ্যাক্টরি ওয়ার্কাররা থাকবেন, কৃষক থাকবেন, জেলে থাকবেন। অন্যান্য পেশার বাসিন্দারা থাকবেন। সবাই মিলে আমরা ইশতেহারটা তৈরি করবো। তখন এটা হবে আসলে তাদের নগর এবং এই থিমেটিক এরিয়াগুলোর মধ্যে ন্যায্যতা কিভাবে নিশ্চিত করা সেটা তাদের আলোচনা থেকেই উঠে আসবে। কারণ, নগর তো আসলে তাদেরই। এই জন্য আমরা বলছি যে, এটা ইশতেহার, রুপরেখা নয়। রূপরেখাটা এক্সপার্টরা করেন। আর এই ইশতেহার তৈরি হবে সবার মতামতের সমন্বয়ে।
আমাদের বার্তা: নগরীর উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এই ইশতেহারটা কিভাবে নিয়েছে বা নিচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হয়েছে কিনা বা আপনারা কোথাও কোনো প্রস্তাব দিয়েছেন কিনা?
মোহাম্মদ এজাজ: যেহেতু এখন রাষ্ট্র গঠনের সময়, সংবিধান লেখা হচ্ছে নতুন করে, সংবিধান সংশোধন কমিটি আমাদের এটা অলরেডি অফিসিয়ালি গ্রহণ করেছে। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমাদের এই ইশতেহারটা কনস্টিটিউশন কমিটির যে ওয়েবসাইট সেখানে দেয়া হবে। আর আমাদের ফাইন্ডিংসগুলো নিয়ে আগামী ২৫ তারিখে আমরা আর একটি ন্যাশনাল সেমিনার করবো। সেখানে দুজন উপদেষ্টা থাকবেন। তখন সংশ্লিষ্ট মিনিস্ট্রিগুলোকে আমরা দাওয়াত করব। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন স্তরে আমরা কথা বলব।
আমাদের বার্তা: জনগণের যে চাওয়া তার সঙ্গে এক্সপার্টদের সমন্বয় কীভাবে করবেন?
মোহাম্মদ এজাজ: নগর পরিকল্পনা কিন্তু এক্সপার্টদের কাজ নয়। আর পরিকল্পনা শব্দটা একটা কলোনিয়াল টার্ম। ওপরে বসে কেউ ঠিক করবে যে আমার জীবন কেমন হবে, কোথায় যাব, কোথায় থাকবো-এমনটা হওয়া উচিত নয়। ঢাকা এখন পৃথিবীর আনলিভেবল শহরগুলোর একটি। ন্যায্যতার জায়গাটা তো নাই-ই, আপনার মতামতেরও কোনো গুরুত্ব নাই। কিন্তু, আপনি যেখানে থাকবেন, সে জায়গায় পরিকল্পনাটা তো আপনাকে নিয়েই করতে হবে। সুতরাং, যাদের জন্য ন্যায্যতাটা নিশ্চিত করতে হবে তাদের নিয়েই আমাদের এই ইশতেহার। কলোনিয়াল ফর্মের মধ্যে আমরা আর চিন্তা করতে চাচ্ছি না। নগরায়নের চর্চাটা আমরা চাচ্ছি ডি কলোনিয়াল ফর্মে।
আমাদের বার্তা: তাহলে যে ন্যায্য নগরের কথা আপনারা বলছেন, কোনো এক্সিস্টিং এক্সাম্পল আছে কি, যেটার সাথে মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারবো যে, ন্যায্য নগর এমন হওয়া দরকার ….
মোহাম্মদ এজাজ: ইটস টোটালি এ নিউ ফ্রেমিং। যেহেতু ন্যায্যতা তৈরিই হয়নি, সুতরাং তার বিরুদ্ধেই তো জুলাই অভ্যুত্থান। এক সময় দেশের বিরুদ্ধে ইনজাস্টিস হয়েছিল ৭১ এ। তখন সবাই সেই ইনজাস্টিসের বিরুদ্ধ দাঁড়িয়েছে। সবসময় ইনজাস্টিসের বিরুদ্ধে কিন্তু জনগণই রুখে দাঁড়িয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানেও আমরা সেটাই দেখেছি। কিন্তু, স্বাধীনতাও তো নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আসলে সেদিনই প্রকৃতভাবে স্বাধীন হবো, যেদিন প্রতিটি স্তরে মানুষকে ডেমোক্রেটাইজেশন করতে পারবো। আমরা মনে করি, আরবান গভর্ন্যান্স এর জায়গা থেকে এক ধরনের ডিসেন্ট্রালাইজেশন প্রয়োজন। বাকিটা আমার বন্ধু ইফাদ বলবেন।
আমাদের বার্তা: বিগত সময়ে বিশেষ করে আমাদের ঢাকা শহরটাকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আমরা যা হারিয়েছি, সেসব পুনরুদ্ধারের উপায় কী?
ইফাদুল হক: সবার আগে গণতান্ত্রিক নগরায়ণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেখানে মানুষ নিজেদের দরকারটা বা কি ধরনের শহর তারা চায় সেটা বলবে। ওইখান থেকেই প্রস্তাব উঠে আসবে যে, গণতান্ত্রিক নগরায়ণের পথে আমরা একসাথে হাঁটবো।
আমাদের বার্তা: বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ যে স্টেজে আছে এই স্তরে থেকে ন্যায্য নগর প্রতিষ্ঠা করা কী আদৌ সম্ভব?
ইফাদুল হক: অবশ্যই সম্ভব। যদি আমরা মানুষের শহর তৈরি করার যে ক্যাপাসিটি সেটাকে স্বীকৃতি দিতে পারি। অভিজ্ঞতা থেকে যদি দেখি তাহলে দেখবেন, গভ:মেন্ট আসলে তেমন কিছু করে না। মানুষ কিন্তু নিজেদের আবাসনের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়। এটা শুধু বাংলাদেশের গল্প না, পুরো গ্লোবাল সাউথের ম্যাক্সিমাম মানুষ নিজেদের বসতি নিজেরাই তৈরি করে। যদিও এটার কোনো স্বীকৃতি নাই। কিন্তু, মানুষের শহর তৈরির যে ক্যাপাসিটি সেটাকে যদি আমরা স্বীকার করতে পারি, স্বীকৃতি দিতে পারি, তাহলে ন্যায্যনগর প্রতিষ্ঠা অবশ্যই সম্ভব। বৈশ্বিক জায়গা থেকে চিন্তা করলে, ইকোনমিক জায়গা থেকে চিন্তা করলে, দিস ইজ দ্যা বেস্ট সল্যুশন। শহর তৈরির জন্য মানুষ যা করছে সেটাকে সাপোর্ট করা।
মোহাম্মদ এজাজ: এই চিন্তাটার মধ্যে কিন্তু একটা ফেলাসি আছে। এটা এমন যে, মানুষের কথা শুনলে তো আমার ডেভেলপমেন্টের প্ল্যানগুলো সফল হবে না। দিস ইজ কলোনিয়াল এগেইন। বলা হবে, এই উন্নয়ন দিয়ে তো আমরা অর্থনৈতিক অবকাঠামো আরো বাড়িয়েছি। আমরা তো অধিবাসীদেরকে আরো মার্জিনালাইজ করেছি। কিন্তু, যারা মার্জিনালাইজড হয়েছে তারা আরো বেশী মার্জিনালাইজড হয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদেরকে আমরা ডেমোক্রেটিক প্রসেসের মধ্যে কখনো ইনক্লুড করি নাই। ডেলিকেটেড ডেমোক্রেসি সব কিছু ঠিক করে দিয়েছে। এটা আসলে শেখ হাসিনার ন্যারেটিভ। এটাই এতোদিন আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, প্রবৃদ্ধি দরকার না উন্নতি দরকার- দ্যাট ইজ ইম্পর্ট্যান্ট। উন্নতিটা নগর জীবনে খুব বেশি দরকার। কারণ সারা বাংলাদেশে আমরা যদি দারিদ্র্যের কথাটা চিন্তা করি- নগরে সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। সারাদেশে কিন্তু ৫০ শতাংশ দরিদ্র নেই। এই যে বৈষম্য। এটা দূর করতে আমি কী প্রবৃদ্ধি চাইবো, নাকি প্রগেস বা উন্নতি চাইবো। প্রগেস চাইলে কিন্তু এ প্রশ্নটা নতুন করে ভাববার অবকাশ রয়েছে।
ইফাদুল হক: আমরা যখন বলছি যে মানুষের কথা শুনতে হবে, তার মানে এই নয় যে এক্সপার্টদের কোনো কাজ নেই। পরিকল্পনাবিদ ও আর্কিটেক্ট যারা আছেন, তাদের যে জ্ঞান, সেগুলো নিয়ে আমরা একটা কোপ্রডাকটিভ মডেলে কাজ করবে। কারণ, মানুষজনের নিজেদের যে ক্যাপাসিটি সেটাকে তো একটা জায়গা দেওয়া লাগবে। এবং সবাই মিলে কাজটা করতে হবে।
আমাদের বার্তা: ঢাকা শহরের খাল, জলাশয়, নদীগুলোর প্রায় সবই লুপ্ত। যেমন ধরা যাক, মতিঝিল। একসময়ের জলাশয় এখন ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। আবার ধরেন কালভার্ট রোড। নিচে ড্রেন। আগে যেটা প্রাকৃতিক প্রবাহ ছিলো, সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেটা এখন কংক্রিটের ড্রেন। এমন অনেক এক্সাম্পল আছে। এসব ক্ষতি স্বীকার করে নিয়ে ঢাকাকে ন্যায্য নগর হিসেবে সাজানো কতোটা সম্ভব?
মোহাম্মদ এজাজ: এখানে দুটো বিষয়। একটা হলো অবকাঠামো। শুধু ল্যাড বেজড প্ল্যানিং না। ঢাকার যে ওয়েটল্যান্ডগুলো দখল হয়েছে সেগুলোর বড় দখলদার সরকার। সুতরাং, মানুষকে যদি গণতন্ত্রায়িত করা যায়. তাহলে দাবি এমনিতেই উঠবে যে, সরকারের স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ কর। এবং সরকার চাইলেই স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে রিসেটল করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ন্যায্যতার আরো অনেক ইস্যু আছে। যেমন, আজকে যে শহরে প্রথম দিন ঢুকলো, তাকে আমরা কতটুকু সুরক্ষার মধ্যে রাখতে পারি। এসে যেনো তার স্যানিটেশনের ব্যবস্থাটা পেয়ে যায়, এসেই কোথাও যেনো উঠতে পারে। তার নিরাপত্তাটাও অনেক জরুরি। কারণ একজন মাইগ্র্যান্টস ভালনারেবল হয়েই শহরে আসে। তাকে তো আমরা আরো ভালনারেবল পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিতে পারি না। কিন্তু, যখন সে শহরে আসছে তখন কিন্তু সিটি গভঃমেন্টের জায়গা থেকে তাকে কোনো নেটওয়ার্কিং এর আওতায় আনা হচ্ছে না। কোনো তথ্যগত সার্ভিস সে পাচ্ছে না। নারী, এডুকেশন, হেলথ সার্ভিস বা ট্রান্সপোর্টেশনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ন্যায্যতা নাই। কারণ এতো দিন এক ধরনের মাফিয়াতন্ত্র ছিলো। নন ডেমোক্রেটিক অথরিটি থাকলে, নন ডেমোক্রেটিক রেজ্যুম থাকলে, কিংবা ডেলিকেটেড ডেমোক্রেসি থাকলেও এটা সম্ভব নয়। সুতরাং, আমরা চাচ্ছি যে, লেট দ্যা পিপল টু গিভ দেয়ার ওপিনিয়ন। তার নগরটা কি রকম চায় সে বলুক। রাষ্ট্র থেকে যখন নগরায়ণের কথা বলা হয়, তখন দালান কোঠা বা এক ধরনের পিকচারাইজেশন করা হয়। কিন্তু আমরা যখন মানুষের কাছে গেছি, কেউ বলেছে যে- আমরা এমন একটা শহর চাই যেখানে আমি রাত সাড়ে ১১টায় বাচ্চা নিয়ে, বউ নিয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে চাই। আমার মেয়েটা, আমার বোনটা যখন ঢাকার রাস্তায় ঘুরবে তারা যেন নিরাপদ থাকে।
ইফাদুল হক: আসলে তো রাষ্ট্র প্ল্যান করে, আর মানুষ সেটা সহ্য করে। সুতরাং, সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আমরা যখন খাল, জলাভূমি বা কোন লেক পুনরুদ্ধার বা পুনরুজ্জীবিত করবো, কিভাবে আমরা মানুষকে সাথে নিয়ে উচ্ছেদ না করে তাদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারি, সে উপায় বের করতে হবে।
আমাদের বার্তা: কিন্তু আমরা দেখেছি যে, দখলকারি বড় গোষ্ঠীগুলো শুরুতে একটু আড়ালে থাকে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামনে ঠেলে দেয়। অনেক মানুষকে অস্থায়ী ঘর করে দেওয়া হয়। তারা দখলের সূচনা করে। তাই, তাদেরকে উচ্ছেদ করলে ন্যায্যতা রক্ষিত হয় নাকি লংঘন হয়?
ইফাদুল হক: এজন্যই তো বলছি, আমাদের মডেলটা একটা কলোনিয়াল মডেল। আমরা ইস্যুগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছি। যেমন হাউজিং এর ইস্যু আলাদা। এনভায়রনমেন্টাল ইস্যু আলাদা। কিন্তু, যে মানুষগুলো ওইখানে থাকছে, তাদের আবাসনের ব্যবস্থা তো করা হয়নি। তাই দখলদাররা গরীবদেরকে একটা শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করে দলখদারিত্বের সুযোগ পায়।
মোহাম্মদ এজাজ: এটার একটা অন্যতম কারণ হলো যে, হাউজিংকে আমরা কমিউডিটাইজ করে ফেলেছি।
ইফাদুল হক: আমাদের অবশ্যই প্রপার হাউজিং লাগবে। এবং রি সেটেলমেন্ট লাগবে।
মোহাম্মদ এজাজ: এজন্য যার জন্য ন্যায্য সে-ই ঠিক করবে যে ন্যায্যতাটা আসলে কি। এটা ডেমোক্রেটিক প্ল্যানিংয়ে কখনোই ছিল না। প্ল্যানিং এবং গভর্ন্যান্স এ দুটোতেই একটা ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিস লাগে।
আমাদের বার্তা: সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারণে ঢাকা নগরীর ন্যায্যতা বহুলাংশে খর্ব হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আপনারা কীভাবে ন্যায্য নগর চর্চায় আগ্রহী করে তুলবেন?
মোহাম্মদ এজাজ: আপনি কিভাবে গভর্ন্যান্সটা করবেন। এটা কি রাজউকের কাজ, নাকি রাজউকের সঙ্গে জনগণের কোলাবোরেটিভ অ্যাপ্রোচ থাকবে। তারপরে এখানে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার কম্পিটিশন থাকবে, নাকি একটা প্রপার সিটি বা লোকাল গভ:মেন্ট থাকবে- হে আলাপটাও আমরা করতে চাই। আমরা এতো দিন শুধু বিড়ম্বনা নিয়েই কথা বলেছি। একজন রাস্তা করে দিয়ে যায়। আরেকজন এসে ভেঙে দিয়ে যায়। এগুলো তো বিড়ম্বনা। আমরা এসবের উপরে উঠতে চাই। আমরা এখন সলিউশনস চাই।
আমাদের বার্তা: ন্যায্য নগরের ইশতেহারে আপনারা অনলাইন ক্যাম্পেইনের শ্লোগান রেখেছেন ---শহরটা কারো বাপের না। ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে নেমে এ অ্যাপ্রোচটা কী একটু অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলো না?
মোহাম্মদ এজাজ: বাংলাদেশ তো একটা চরমপন্থা ছিলোই। এই প্রচারণা দিয়ে আসলে ওই চরমপন্থাটাকেই রিকনসট্রাক্ট করা হয়েছে।
আমাদের বার্তা: তার মানে আপনারা মনে করছেন যে, কেউ কেউ শহরটাকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে?
মোহাম্মদ এজাজ: এখনো করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো মূলত এমনটাই মনে করে- এগুলো তো আমাদের সম্পত্তি।
ইফাদুল হক: এখানে এক ধরনের ব্যাপক কর্তৃত্ব চর্চা করা হয় যে- এটা শুধু রাজউকের- এটা পিডব্লিউডির। এর কাজ এইটা, ওর কাজ ওইটা।
মোহাম্মদ এজাজ: এ ধরনের টেরিটোরিয়াল ইস্যুজ এক ধরনের মার্জিনালাইজেশন তৈরি করে।
ইফাদুল হক: আমরা সবাই আলাদা আলাদাভাবে কাজ করি। কিন্তু আমাদের শহরে বহু মানুষ। তাদের চিন্তাভাবনাও বৈচিত্র্যময়। সবকিছুকে মিলিয়ে আসলে আমরা ন্যায্য নগরের ইশতেহার এগিয়ে নিতে চাই।