শিক্ষককে অপূর্ণ রেখে পূর্ণ শিক্ষা অসম্ভব - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষককে অপূর্ণ রেখে পূর্ণ শিক্ষা অসম্ভব

নীলোৎপল বড়ুয়া, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন। স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানী শাসনের সময়ের ও স্বাধীনতার পরবর্তী  বাংলাদেশ সময়ের দেশের শিক্ষার চিত্র নিয়ে কথাটি এভাবে বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজল। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও শিক্ষাক্ষেত্রে সেই নৈরাজ্য যে কেবল  রয়ে গেছে তা নয়, তার ওপর নতুন নতুন নৈরাজ্য যুক্ত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা নিজেরাই এ অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। আমরা মানে আমাদের সরকার, নেতা-উপনেতা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ছাত্র, অভিবাবক সবাই। লক্ষণীয় যে, এই নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনে তিনি শিক্ষকদের কথা আনেননি। কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষকবৃন্দকে  এতই দুর্বল ও দীন-হীন করে রাখা হয়েছে যে তারা শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের রাজ্য তো দূরের কথা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করতেও অক্ষম।

একজন শিক্ষক কখনো শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন না। তবে বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের জন্য কোনো কোনো জায়গায় বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকরাও দায়ী। অবশ্য তারা শিক্ষকেরও অধিক নেতা, দলদাস ও কর্মকর্তা। তারা নিজেদের হীন স্বার্থে দলীয় ক্ষমতায় এই নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন। তাদেরকে স্টাডি করলে দেখা যাবে তারা শিক্ষক হিসেবে একেবারে নিম্নসারির। দেশের নষ্ট রাজনীতি ও শিক্ষাবিধি ব্যবস্থার দুর্বল কাঠামোর কারণেই আসলে তারা এই নৈরাজ্য করার সুযোগ পায়। তারা শিক্ষা-সংস্কৃতি বুঝেন না। তাই তাদের উদাহারণ  দিয়ে শিক্ষক বিচার করা ভুল হবে। তাদের সংখ্যা খুব অল্প। দেশের শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সুফল  অর্জন করতে চাইলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে আর সবার আগে শিক্ষককে মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষক ছাড়া কোনো শিক্ষাই বাস্তবায়ন সম্ভব না। আবুল ফজলের কথাটাই কিন্তু ঠিক - রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এক জিনিস, শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।

পিতা-মাতা সন্তানের অভিভাবক। তারা তাদের অধীনস্ত সন্তানদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু ক্ষুধার্ত রাখেন না। শিক্ষকও রাষ্ট্রের অধীনস্ত। রাষ্ট্রই শিক্ষকের অভিভাবক। শিক্ষককে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে, শাসন করবে কিন্তু তা নিশ্চয় শিক্ষককে ক্ষুধার্ত রেখে নয়। শুধু রাষ্ট্র দ্বারা নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানপ্রধান দ্বারাও আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষকদের বঞ্চিত ও নিপীড়িত হতে হয়। এই প্রতিষ্ঠান প্রধান কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকপ্রধান। অতএব তাকে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষকদের চেয়ে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে এবং বেশি পড়ালেখা জানা মানুষ হতে হবে। শুধু তাই নয়, তাকে হতে হবে দয়াশীল ও সুবিবেচনাবোধ সম্পন্ন। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা সেরকম নয় বরং তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  কর্তৃত্ববাদি, স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়। অতএব একজন শিক্ষক যদি ঘরে-বাইরে সব জায়গায় বঞ্চিত হন, নিপীড়িত হন তাহলে তিনি শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দিবেন! তার প্রাণটাই যদি সজীব না থাকে, তিনি যদি অভাবের উর্ধ্বে না থাকতে পারেন, তাহলে তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষারর্থীদের কিভাবে প্রাণিত করবেন?  এতে আপনি যতই ভালো শিক্ষানীতি, ভালো শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম, ভালো শিক্ষা পদ্ধতি  তৈরি করেন না কেনো কোনো লাভ হবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে। মানুষকে ছাঁটিয়া ফেলিলে সে তখন আর মানুষ থাকে না, সে তখন আপিস আদালতের বা কল কারখানার প্রয়োজনীয় সামগ্রী হইয়া উঠে।’

শিক্ষা থেকে জাতীয় জীবনে সুফল পেতে হলে প্রথমেই শিক্ষকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে একটি রাজনৈতিক প্রভাববিহীন, অভাবমুক্ত নিরাপদ সম্মানজনক স্বাধীন জীবন। এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নিজের সন্তানকে অভুক্ত রেখে নিশ্চয় একজন শিক্ষক অপরের সন্তানের প্রতি ভালো মনোযোগ দিতে পারবেন না। শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা শব্দটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে। মানুষ বলে শিক্ষাদীক্ষা। তার মানে একজন শিক্ষক কেবল শিক্ষক নন, দীক্ষকও বটে। শিক্ষিত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার শিক্ষার্থীদের দীক্ষিতও করেন মানবতা, নৈতিকতা, উদারতা, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, ইত্যাদিতে। একজন শিক্ষকের প্রচেষ্টা থাকতে হবে চাকরিজীবীর সীমাকে অতিক্রম করে নিজেকে একজন  দীক্ষকে পরিণত করা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র,  সমাজ ও প্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষককে কেবল চাকরি করতে বাধ্য করায় তাহলে তিনি কেবল চাকরিই করবেন। আপনার সন্তানকে দীক্ষিত করতে পারবেন না। তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষকের মর্যাদা সবার উর্ধ্বে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষককে দিলে তা বহুগুণ আকারে আপনার সন্তানের কাছেই ফিরে আসবে। শিক্ষককে অসম্মানজনক অবস্থানে রেখে, কম পারিশ্রমিক দিয়ে রাষ্ট্র নিশ্চয় তাদের কাছ থেকে উৎকৃষ্ট কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না। আর এ অবস্থায় আপনারাও আপনাদের সন্তানদের জন্য কি প্রত্যাশা করবেন! 

আমাদের দেশে শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। তবে কথা হচ্ছে, যে কারিগর নিজে মাত্র অর্ধেক মানুষ, তিনি কিভাবে পূর্ণ মানুষ গড়তে পারবেন। তাই তো আমাদের দেশের শিক্ষকরা মানুষ গড়তে পারেন না। দেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও লাট সাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের এক ঠ্যাং-এর সমান মাইনে পাওয়া শিক্ষক কিভাবে একজন পূর্ণ মানুষ হতে পারবেন!

লেখক : প্রভাষক, হাজী এম এ কালাম সরকারি কলেজ, নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)

পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আইইউটির ৩ ছাত্রের মৃত্যু - dainik shiksha পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আইইউটির ৩ ছাত্রের মৃত্যু অনার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বাদ দেয়া উচিত - dainik shiksha অনার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বাদ দেয়া উচিত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে - dainik shiksha প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত - dainik shiksha স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত নতুন পাঠ্য বইয়ে থাকছে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের বীরত্বগাথার গল্প - dainik shiksha নতুন পাঠ্য বইয়ে থাকছে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের বীরত্বগাথার গল্প শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি - dainik shiksha শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম পর্যায়ের ভর্তি আজকের মধ্যে - dainik shiksha গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম পর্যায়ের ভর্তি আজকের মধ্যে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032758712768555