প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইউনেস্কো যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালন করে আসছে। মূলত শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই দিবস পালন। ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেও এবার যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে শিক্ষকদের অধিকার নিয়ে কম বেশি লেখালেখি হয়। আলোচনা কিংবা সভা-সেমিনারও কম হয় না। কিন্তু অধিকার বাস্তবায়নে যুগের পর যুগ যথেষ্ট শিথিলতা লক্ষণীয়। শিক্ষকতা পেশা সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা, প্রাপ্যতা ও অধিকারের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে অবহেলিত বলা চলে।
শিক্ষা ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি এবং জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা ব্যক্তির দেহ-মনের সুষম বিকাশের মাধ্যমে একদিকে যেমন আধুনিক ও কর্মপোযুক্ত করে তুলে অন্যদিকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে টিকে থেকে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণের মানসিকতা তৈরি করে। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান মূল্যবোধ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সম্পন্ন যোগ্য নাগরিক গড়ে উঠে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই স্বাভাবিক কারণে একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
উন্নত দেশগুলো শিক্ষা খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শিক্ষাকে জাতীয় বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে জিডিপির বৃহৎ অংশ এ খাতে বিনিয়োগ করে। এশিয়ার অনেক দেশও শিক্ষা খাতে যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ এর অন্যতম উদাহরণ। সত্তর- আশির দশকে এসব দেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগ করেছে যা পরবর্তীতে তাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা বিনিয়োগ এসব দেশের ধারে কাছেও নেই। তেমনি বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার দিক থেকে শিক্ষকরা অনেক পিছিয়ে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে।শিক্ষা মানুষের অধিকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদেও এটি নাগরিকের অধিকার হিসেবে বিবেচিত। সংবিধানে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা থাকলেও এখনও পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তার জন্য হয়তো নানা আর্থ-সামাজিক কারণ থাকতে পারে। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের অর্জন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কারো দ্বিমত থাকার কথা না। শিক্ষার হার যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি উচ্চ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। একইভাবে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রথাগত ও ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্ততে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক ধ্যানধারণা গড়ে উঠছে। নারী শিক্ষার অগ্রগতি যেকোনো দেশের অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে বহু আগে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি যে শিক্ষক সমাজ তা জোর দিয়ে বলা যায়। শিক্ষকরা জাতি গঠনের মূল কারিগর হলেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী থেকে প্রাপ্তির দিক থেকে অবহেলিত। সরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকরা যেমন পদোন্নতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্য পেশাজীবী থেকে পিছিয়ে তেমনি বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। শিক্ষকদের বৃহৎ অংশই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। দেশের নব্বই ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের যথাযথ উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে মেধাক্রম অনুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া অবশ্য একটি সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষা জীবনের ফলাফলও গণ্য করা হলে এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো বাস্তবসম্মত হতো বলে অনেকের ধারনা। পরবর্তী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো হয়তো বিবেচনায় আনা যেতে পারে এবং অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদেও একই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। তবে শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রত্যাশা অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি ‘বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন’ গঠন করা হলে শিক্ষক সমাজ আরো বেশি খুশি হবে। এ কমিশন নিয়োগ ছাড়াও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য বিষয়েও তদারকি করতে পারে। বিগত কয়েক বছর রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদী কাঠামোর আদলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এক ধরনের ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছিলো যা একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছে অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। একই ভাবে এই কাঠামোয় আবদ্ধ হয়ে অনেক সৎ, যোগ্য ও প্রতিবাদী শিক্ষকরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বৈষম্য, বঞ্চিত ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন দেশের হাজারো শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ গড়ে তোলা অতীব জরুরি।
শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবী দীর্ঘদিনের। কেনোনা শিক্ষা মানুষের অধিকার। রাষ্ট্র কিংবা সরকারের কোনো ধরনের দান বা সহযোগিতা নয়। ফলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বহুকাল আগ থেকে। যতদিন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ হচ্ছে না ততদিন রাষ্ট্র কর্তৃক বেসরকারি শিক্ষকদের সম্মানজনক ও বাস্তবভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া যেতে পারতো। কিন্তু তাও অনেকাংশে সম্ভব হয়ে উঠেনি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা অসঙ্গতি ও বঞ্চনার ইতিহাস। পদোন্নতির ক্ষেত্রে খানিক জট ছাড়নো গেলেও বড় জট রয়ে গেছে আমলাতান্ত্রিক চক্রে আবদ্ধ হয়ে। অন্যদিকে সারা দেশে গ্রামে-গঞ্জে বেসরকারি কলেজগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে যা উচ্চ শিক্ষা প্রসারের পথকে প্রশস্ত করছে। কিন্তু অনার্স কোর্সে পাঠদানের জন্য নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কোন এমপিও নেই। তাই অধিকাংশ কলেজেই তারা খুব কম বেতন-ভাতা পেয়ে থাকে যা পরিবার-পরিজন নিয়ে চলার জন্য মোটেও উপযোগী নয়। আবার দীর্ঘদিন একই পদে থেকে অনেকে যে আগ্রহ নিয়ে এ পেশায় আসেন সেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির জন্য একটি সময় উপযোগী নীতিমালাও জরুরি। অবসরে গেলে আবার অবসর সুবিধা পেতে পেতে অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজেই দুনিয়া থেকে অবসরে চলে যান। বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
জ্ঞানীরা বলে থাকেন একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। যথাযথ শিক্ষা কিংবা নৈতিক শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে উঠতে পারে না। কেনোনা শিক্ষাই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। আর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করতে হবে। শিক্ষকদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের পদন্নোতি ও পেশাগত মানোন্নয়ন এবং সম্মানজনক আর্থিক সুবিধার দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিরাপত্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমতা প্রভৃতি নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, বাস্তব সিদ্ধান্তই আগামি দিনে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠার পথকে প্রশস্ত করবে। যৌক্তিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে ছাত্র-জনতার রক্ত ও ত্যাগে গড়ে ওঠা সরকার শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষটি যথাযথ গুরুত্ব দিবে বলে আমার বিশ্বাস। তাহলেই হাজারো শহীদের স্বপ্নের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হবে।
লেখক: সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম