সারা দেশে যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পরে অবশেষে দেশের লাখ লাখ শিক্ষক এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণ নেয়া বা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা মানে এটা নয় যে সকল শিক্ষক পরিবর্তিত কারিকুলাম বুঝে গেছেন। আমারও মনে হয় আমাদের দক্ষ শিক্ষক সমাজ অবশ্যই বুঝবেন, তবে কেউ আগে আর কেউ একটু পরে। নিঃসন্দেহে পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার ছিলো। দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণে শিক্ষার্থীদের যুগের যোগ্য করে তুলতে সকল স্তরের শিক্ষককে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। আমরা সবাই ভালো শিক্ষক নই, কিন্তু মহান পেশার মান ধরে রাখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। ভালো শিক্ষক না হলে যোগ্য প্রশিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। এক প্রকার বলতে গেলে, আমরা সবাই জেনে বুঝে এই পেশাকে গ্রহণ করেছি। তবে কেনো বারবার নিজেকে অপরের কাছে সমালোচনার পাত্র তৈরি করা।
যে জাতির শিক্ষা বা দেশের শিক্ষার অবকাঠামো ও শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ যতো উন্নত, দেশ ও জাতি হিসেবেও তারা উন্নত। জাতীর সুগঠিত জাতিসত্তা গঠনে মূল কাজটি করেন আমাদের শিক্ষকরা। আমাদের উচিত শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা এবং তাদের কাছ থেকে জীবনে সৎমানুষ হওযার দীক্ষা গ্রহণ করা। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের জীবনটা বদলে যায়। বাবা-মায়ের স্নেহের ছায়াতলে বেড়ে উঠতে থাকা আমরা যখন দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাই শিক্ষকদের সান্নিধ্যে তখন শিক্ষকই হয়ে ওঠেন আমাদের বাবা-মা। বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতি অত্যাচারী শাসকও নতশীরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের ঔদ্ধত্য কেউ দেখাননি। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। কারণ, শিক্ষকরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। এক কথায় বলা যায়, শিক্ষক আমাদের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা, উন্নত ও সৎ জীবনাদর্শের বলয়ে এনে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করেন।
শিক্ষাকে উন্নয়নের পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হলে শিক্ষকের ভূমিকার গুরুত্ব বলে শেষ করার নয়। বলতে গেলে এর বিকল্প নেই। একজন প্রযিতগাথা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সুনাগরিক, যোগ্য নেতা, সত্যিকারভাবে শিক্ষিত শিক্ষক সমাজ সৃষ্টিতে একটি বিশেষ ভূমিকা পারেন। আদর্শ শিক্ষকই শুধু আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে পারেন। যুগ যুগ ধরে এটি একটি সুমহান পেশা হিসেবে সমাজ-সংসারে পরিগণিত। কারণ, জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে। সুতরাং যার থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয়, তিনিই আমাদের শিক্ষক। অথচ এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত, তাদের নেই কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানজনক জীবনধারণ উপযোগী বেতন-ভাতা না থাকায় মেধাবীরা শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না।
শিক্ষকরা সমাজের বিবেক ও স্পন্দন। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করার ব্যাপারে শিক্ষকদের অবদান আজো মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। শিক্ষকরা হচ্ছেন দেশ গড়ার প্রধান শক্তি। তাই শিক্ষকদের আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষাদানে তৈরি করে তুলতে হবে। টেকসই উন্নয়নের চারটি লক্ষ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে গুণগত শিক্ষা, যা ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অর্জন করবো বলে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি। সেই লক্ষ্যে সরকার নতুন কারিকুলাম নিয়ে এসেছে। সবার এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে এর জন্য দরকার বাড়তি পরিশ্রম, মর্যাদাহীনতায় ভোগার কারণে সেই বাড়তি পরিশ্রম করার কোনো উদ্দীপনা তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের মতে, সব দেশেরই বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে স্বীকৃতি দান এবং দিবসটি উদযাপিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদা সুরক্ষায় ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১৪৫টি সুপারিশ গৃহীত হয়। এসব সুপারিশের মধ্যে শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, দায়িত্ব ও অধিকার, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা উপযুক্ত সুপারিশসমূহ অনুমোদন করে।
ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকরা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। সবার মধ্যে সচেতনতা, উপলব্ধি সৃষ্টি ও শিক্ষকদের ভূমিকার স্বীকৃতি স্মারক হিসেবে দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে ও সামাজিক, অর্থনৈতিক, দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি বিনির্মাণে শিক্ষকরা তাদের ভুমিকা রাখছে। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এতো বছর পরেও বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রকৃত মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কম দায়ী নয় তারপরও শিক্ষকরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছেন। তাই শিক্ষকদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে, তাদের যথাযথ সম্মান করতে হবে ।
সাম্প্রতিক কিছু বিষয় উপস্থাপন করতে চাই। বিষয়গুলো কারো কারো খারাপ লাগতে পারে কিন্তু একটু ভাববার অনুরোধ রইল। আমরা এমন কিছু করি তাতে নিজেদের মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। আমার কাছের এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা সংবাদ শুনে আনন্দিত হয়েছি যে সম্প্রতি শেষ হওয়া প্রাথমিক শিক্ষায় এক প্রশিক্ষনে দেশের নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা একাডেমিক শিক্ষা শেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য, আমাদের সবার জন্য এটা আশার বাণী। কিন্তু এই ভেবে আবার ভয়ও পাচ্ছি, একে তো বেতন কম আবার তাতে যদি মান নিয়ে টান পড়ে, তাহলে নতুনরা কি এ পেশায় থাকবেন?
এখানে টাকার বিনিময়ে জিপিএ-৫ বিক্রি হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল্যায়ন পত্র বিকাশের মাধ্যমে টাকার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। বছর শেষে বিগত খ্রিষ্টাব্দের নতুন বই দিনের নতুন আলো ফোটার আগেই হারিয়ে যায়। আরো বিস্মিত হই, যখন দেখি আমাদের সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত প্রতিবন্ধীদের টাকা তাদের না দিয়ে সে টাকায় বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়।
২০২৪ খ্রিষ্ঠাব্দের ৮ম ও ৯ম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণে নৈশ প্রহরী, অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপরেটর, চাকরিচ্যুত ব্যক্তিও অংশগ্রহণ করেন। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক, এনটিআরসিএ সনদবিহীন নন-এমপিও শিক্ষকদের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য মনোনিত করেছেন। শিক্ষকপ্রতি ৮০ টাকার নাশতার পরিবর্তে ২০-৩০ টাকার নাশতা খাওয়ানো হয়েছে যার মধ্যে পচা-বাসি সিংগাড়া ও পুরি ছিলো। এ খাবার খেয়ে অনেক শিক্ষক অসুস্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। প্রশিক্ষণ উপকরণ ছিলো অত্যন্ত নিন্মমানের।
উপস্থিত প্রশিক্ষণার্থী তালিকার বাইরেও অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী দেখিয়ে ভাতার টাকা উত্তোলন করে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আত্মসাৎ করার পায়তারা করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ২০ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্র হিসেবে দেশের ৪ হাজার ১৭৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেরামতের জন্য কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। মোরেলগঞ্জে ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পায়। বাস্তবতা হলো চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্র সংস্কারের জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন অফিসের তালিকায় ৪টি বিদ্যালয়ই ভোটকেন্দ্র নেই। এক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, তার বিদ্যালয়ে কোনো ভোটকেন্দ্র নেই। এই বিদ্যালয় সংস্কারের জন্য কোনো টাকা বরাদ্দ আছে কিনা তাও তার জানা নেই।
অপরদিকে, অন্য এক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, আমার বিদ্যালয়ে ভোট কেন্দ্র না, ভোটকেন্দ্র হিসেবে বিদ্যালয় সংস্কারের যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে টিইও’র নির্দেশে সে টাকার কাজ চলছে। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকৌশলী বলেন, ভোটকেন্দ্র সংস্কারের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসা অর্থের কাজের কোনো অনুমতি আমি দিইনি। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল। আরো অনেক ঘটনা আছে। বললে আবার অনেকের বলতে দেখেছি সবাই শুধু দোষ দেখে, ভালোটা দেখে না। তবে একটা স্বস্তির বিষয় যে, দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু কেনো জানি এই বিষয়গুলো আর কোনো কিছু না হলেও পদোন্নতি নিশ্চিত হয়ে যায়! এখন বিচারের ভার শিক্ষক সমাজের কাছে দিলাম।
এতো কিছুর পরেও অনেকে আছেন এই সমাজকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে বিলিয়ে, নিশ্বেষ করে দিয়েছেন। তাই কেউ শিক্ষকের দিকে আঙুল তুললে অন্তরে লাগে। তাইতো অকপটে, নতমস্তকে স্বীকার করি, শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে; শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তবে আপনার মান আপনাকে রক্ষা করতে হবে। শিক্ষকের মান মর্যাদা ধরে রাখার দায়িত্ব শিক্ষককে নিতে হবে। দেশব্যাপী শিক্ষকদের বৈধ অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা করা, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত করার ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সু-সম্পর্ক তৈরি এবং শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠ শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
সর্বোপরি দেশকে বিশ্ব দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করতে হবে। শেষ করতে চাই ভারতের এ পি জে আবদুল কালামের একটা কথা দিয়ে। তা হলো- ‘তিনজনই পারেন একটি দেশ, জাতিকে বদলাতে, তারা হলেন- পিতা, মাতা ও শিক্ষক।’
লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার টেকনিক্যাল অফিসার
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।