পশ্চিমবঙ্গের বহুল আলোচিত সরকারি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে ফের গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যটির শাসকদলের প্রভাবশালী বিধায়ক। বহু নাটকীয়তা ও দীর্ঘ প্রায় ৬৫ ঘণ্টার ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তৃণমূল কংগ্রেসের মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহাকে গ্রেফতার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ (সিবিআই)।
তদন্ত শুরুর প্রথম দিন, শুক্রবার দুপুর সাড়ে বারোটায় বিধায়কের মুর্শিদাবাদের আন্দি গ্রামের বাড়িতে দুটি গাড়িতে আসেন সিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তে গতি আনতে ওইদিনই মুর্শিদাবাদে পৌঁছান আরও সিবিআই কর্মকর্তারা। এরপর একটানা ৬৫ ঘণ্টা ধরে চলে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি অভিযান। সোমবার ভোররাতে আরও একটি গাড়িতে সিবিআইয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আন্দি গ্রামে বিধায়কের বাড়িতে পৌঁছান। নিরাপত্তা জোরদার করতে তাদের সঙ্গে আসেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যরা। অবশেষে এদিন ভোর সোয়া ৫টার দিকে জীবনকৃষ্ণকে গ্রেফতার করে সিবিআই। কড়া নিরাপত্তায় মুর্শিদাবাদ থেকে গাড়িতে তাকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার নিজাম প্যালেসে সিবিআই দপ্তরে।
সিবিআই সূত্রে জানা যায়, নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩০০ কোটি রুপির লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে জীবন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। চাকরি দেওয়ার নাম করে এই বিধায়কই সেই অর্থ তুলেছিলেন। তদন্তকারীদের ধারণা- কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থীর মাথা পিছু ৬ থেকে ১৫ লাখ রুপি করে নেওয়া হয়েছিল। সোমবার দুপুরে তাকে কলকাতার আদালতে তুলে নিজেদের হেফাজতে চাইতে পারে সিবিআই। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই দুর্নীতির আরও গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে তদন্তকারী সংস্থা।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জীবনকৃষ্ণের আগে দুজন বিধায়ক গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারা হলেন- পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মানিক ভট্টাচার্য। স্বাভাবিকভাবে এই ঘটনায় বেশ কিছু ব্যাকফুটে মমতা ব্যানার্জির দল ও সরকার।
প্রসঙ্গত, জীবন কৃষ্ণ সাহার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গেলে নানা নাটকীয়তার মুখোমুখি হয় সিবিআই। অভিযোগ তদন্তের শুরু থেকেই অসহযোগিতা করছিলেন তৃণমূল বিধায়ক। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন অসুস্থতার অজুহাতে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে অভিযুক্ত বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জন্য তার কাছে থাকা মোবাইল ফোনটি ছুড়ে ফেলেন বাড়ির পিছনে থাকা পুকুরে। মোবাইলের সন্ধানে শনিবার মটর পাম্প চালিত যন্ত্র এনে পুকুরের পানি সরিয়ে তল্লাশি অভিযান শুরু করা হয়। টানা ৩৮ ঘণ্টা ব্যয় করে পুকুরের পানি তুলে সিবিআই কর্মকর্তারা একটি মোবাইল ফোনের সন্ধান পান।
অভিযোগ জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি অভিযান চলাকালীন বাড়ির প্রাচীর টপকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বিধায়ক। অভিযুক্ত বিধায়কের বাড়ি ছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জে অবস্থিত বিধায়কের শ্বশুর বাড়িতেও দীর্ঘ তল্লাশি চালায় সিবিআই। তদন্ত শুরুর মুখেই বিধায়কের বাড়ির পেছনে রাইস মিলের প্রাচীর সংলগ্ন জঙ্গল থেকে পাঁচটি ব্যাগ ভর্তি নথি উদ্ধার করেন সিবিআই কর্মকর্তারা। সেই ব্যাগগুলি থেকে তারা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির একাধিক নথি বাজেয়াপ্ত করেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও বিধায়কের শোয়ার ঘরের বিছানার নিচে থেকে বেশ কয়েকটি ফাইল ও ঠাকুর ঘরের সিঁদুরের কৌটা থেকে একটি পেনড্রাইভ পাওয়া গেছে বলেও জানা যায়।
এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় প্রথম গ্রেফতার হন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার ঘনিষ্ঠ অর্পিতা চ্যাটার্জি। তাদের গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। সে সময় অর্পিতা চ্যাটার্জির টালিগঞ্জ ও বেলঘড়িয়ার দুইটি অভিজাত ফ্লাট থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ৫০ কোটি রুপি, গহনা, শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কিত বিভিন্ন নথি। এরপর থেকে এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গত প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূলের বিধায়ক, প্রভাবশালী নেতা, রাজ্যের সচিবরা। তারা প্রত্যেকেই এখন কারাগারে বন্দি। তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের দাবি- নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর থেকেও বড় মাপের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ।