শিক্ষক নির্যাতন, জাতির জন্য লজ্জা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক নির্যাতন, জাতির জন্য লজ্জা

শাকিল কালাম |

আমরা শিক্ষকদের নানা অভিধায় অভিষিক্ত করে থাকি। জাতির বিবেক, জাতিগড়ার কারিগর ইত্যাদি ইত্যাদি। খৃষ্টপূর্বকালের দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, জন্মদানের জন্য তিনি পিতার আর শিক্ষার জন্য শিক্ষকের কাছে ঋণী। তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রাচীনকাল থেকে শিক্ষকতা একটা সম্মানজনক পেশা হিসাবে সবার কাছে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ শিক্ষক  সমাজের সম্মানের উচ্চতা নিয়ে অনেক গল্প-কবিতাও রচিত হয়েছে। ছোটকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাংলা ভাষার অন্যতম কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। কবিতায় তিনি মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, মানসম্মান এবং ভালোবাসার এক চমকপ্রদ কাহিনীটি তুলে ধরেছেন। বাদশাহর ছেলেকে দিল্লীর একজন মৌলভী সাহেব পড়াতেন। একদিন সকালবেলা বাদশাহ দেখেন, ওস্তাদ অজু করার সময় তাঁর ছেলে ওস্তাদের পায়ে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছে। তা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওস্তাদকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু খবর পেয়ে ওস্তাদ বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন, বাদশাহ তাকে ভীষণ শাস্তি দেবেন, এমন কী শুঁলেও চড়াতে পারেন। তারপর মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে রাজদরবারে গেলেন। বাদশাহ তাঁকে খাস কামরায় ডেকে নিয়ে যা বললেন, তা শুনে ওস্তাদ অবাক হয়ে যান। উচ্ছ্বসিত শিক্ষক বাদশাহকে সালাম করে বললেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’ 

শিক্ষকদের সম্মান করার কথা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ধর্মেই তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে শিক্ষককে (জ্ঞানী) সম্মান করলো, সে আমাকেই সম্মান করলো। যে আমাকে সম্মান করল সে আল্লাহকে সম্মান করলো। মহানবী (সা.)এর এই ঘোষণা শিক্ষক সমাজকে শ্রদ্ধাবোধের চরম শিখরে তুলে দিয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রে গুরু পরম শ্রদ্ধেয়। বৌদ্ধধর্মে, মহামতি বৌদ্ধ নিজেই শিক্ষক। কিন্তু এর বিপরীতে দেখা যায়, আজকের আর্থ-সামাজিক, রাষ্টীয় এবং পারিবারিক ব্যবস্থায় শিক্ষকদের মান-সম্মানে বিষয়টি কোন স্তরে পৌঁছে গেছে..তা ভাবার সময় এসে গেছে। 
আজ শিক্ষকেরা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্র, অভিভাবক, ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক নেতারদের দ্বারাও অপমানিত, লাঞ্চিত, নির্যাতিত এবং অসম্মানিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তখন সমাজের বিবেকবান মানুষরা দুঃখ-বেদনায় হৃদয় কষ্টে নীল হয়ে যান। কিন্তু, তথ্য প্রযুক্তির যুগে শিক্ষক নির্যাতনের যে ঘৃণ্য চিত্র উঠে এসেছে, তা অবিশ্বাস্য এবং কল্পনাতীত। তার কয়েকটি উদহারণ দেয়া হলো :

১।২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস করানো অভিযোগ ওঠে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে। 

২।২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন নড়াইল জেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায়ের এক ফেসবুক পোস্টে ধর্ম অবমাননার সূ্ত্র পুলিশের উপস্থিতিতেই কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের জুতার মালা গলায় পরানো হয়। 

৩। আশুলিয়ার চিত্রশাইল হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে বিভিন্ন সময় নিয়ম-কানুন মানাতে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার শাসন করেন। এ কারণেই ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুন উক্ত ছাত্র ক্ষোভ থেকে ওই শিক্ষককে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে অতর্কিত আঘাত করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। 

৪. ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়৷ 

৫। লক্ষীপুর সদর উপজেলায় একজন শিক্ষক এক ছাত্রকে ৫ বছর আগে পরীক্ষায় নকল করতে বাধা দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ক্ষোভ পুষে রেখে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মে সে ছাত্র উক্ত শিক্ষকের ওপর হামলা চালায়৷

৬। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা ফেব্রুয়ারি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর বিয়ে বন্ধ করায় তরিকুল ইসলাম নামে নোয়াখালীর এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গাছের সঙ্গে বেঁধে মেয়েটির পরিবার নির্যাতন চালায়। 

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র আমিনুর বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। কয়েক মাস আগে ছাত্রলীগ তাঁকে হল থেকে বের করে দেয়। উল্লেখ্য, তিনি মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। গত ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর আমিনুর ছাত্রলীগের এক ‍গ্রুপের সহায়তা নিয়ে আবার হলে উঠতে যান। তখন ছাত্রলীগের অপরগ্রুপের নেতাকর্মীরা তাঁকে হলে উঠতে বাধা দেন। এ নিয়ে দুগ্রুপের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। খবর পেয়ে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হন এবং বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। এ সময় হল প্রাধ্যক্ষ  মোকাদ্দেস উল ইসলাম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত হল শাখার সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তাঁরা সেথানে হইচই শুরু করেন। তখন হলের সহকারী প্রক্টর অমিত দত্ত তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায় এনায়েত উল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন নেতাকর্মী সহকারী প্রক্টর দিকে তেড়ে যান এবং তাঁকে লাঞ্ছিত করেন। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী। 

উপরোক্ত ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সমাজের প্রতিবাদের ভাষা কী হওয়া উচিত ছিলো? বা তাঁদের ভূমিকা কেমন ছিলো? তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনেও উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সমাজের নৈতিকতার যে উচ্চ অবস্থান থাকার কথা ছিলো, তা এখন আর তেমন দেখা যায় না। মনে হয়, প্রতিবাদের জায়গাটি দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমাদের অধ্যয়নকালে আমরা যা দেখেছি, এ রকম কোন ঘটনা ঘটলে প্রথমেই  তীব্র প্রতিবাদের আওয়াজ উঠতো শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। তখন শিক্ষক সমাজের প্রতিবাদে জাতির বিবেকের প্রতিফলন ঘটতো। এখন সে জায়গাটি কোথায়? তাঁরা এখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন! তবে এখনো দু’একজন বিবেকবান  শিক্ষক একাকী হলেও প্রতিবাদ করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলগুলোতে প্রধান ছাত্র সংগঠনের  দখলদারিত্ব, সিট-বাণিজ্য এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তিনি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন এবং  ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক ভবনের সামনে জোহা চত্বরে প্রতীকী অনশন করেন।

শিক্ষক সংগঠনগুলোর জাতীয় রাজনীতির প্রতি দৃশ্যমান আনুগত্য প্রকাশ, তাঁদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এখন তাঁরা জাতীয় রাজনীতির আদর্শিক দিক বিবেচনা করেই কোনো ঘটনার প্রতিবাদ করবেন কীনা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। অনেকসময় কতিপয় শিক্ষক নিজেদের স্বার্থ হাসিল বা পদ-পদবি লাভ এবং তা রক্ষায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ফলে যেসব শিক্ষক এ ধরণের  কর্মকাণ্ডে জড়িত স্বভাবতই তাঁরা ছাত্রনেতাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য আসনে পদায়ন করা হচ্ছে না। যার ফলে আমরা এমন একটা অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছি; সেখান উঠে আসতে কত সময় লাগবে বা আরো কতো গভীরে যেতে হবে..তা একমাত্র ভবিতব্য বলতে পারে! বলা যায়, সামগ্রিকভাবে আমাদের নীতি-নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনা এবং মননে দারুণ ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষতের চিকিৎসার জন্য এখনই জায়গাগুলোতে রাশ টেনে ধরতে হবে। যাঁর ওপর আস্থা রেখে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই, তাঁর কাছ থেকে যেনো অতিসত্ত্বর নির্দেশনা আসে। আমরা যে যেখানে  আছি, সবাই যেনো অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট হই। 

লেখক : শাকিল কালাম, কবি ও গবেষক

 

ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034980773925781