কেশবপুরে শুধু শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগেই ৫০ কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাড়ে তিন বছরে কেশবপুর উপজেলার ৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৫৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাবেক এমপি ও যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। রোববার (১ ডিসেম্বর) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন নূর ইসলাম।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে বেরিয়ে আসে শাহীন চাকলাদারের নিয়োগ বাণিজ্যের ভয়ঙ্কর কাহিনী। তার এই নিয়োগ বাণিজ্যে সহযোগিতা করতেন এপিএস আলমগীর সিদ্দিক টিটো, কেশবপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল, উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মফিজুর রহমান ও তৎকালীন কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এমএম আরাফাত হোসেন।
শাহীন চাকলাদার ক্ষমতার দাপট দেখিছে গত সাড়ে ৩ বছরে উপজেলার এমপিওভুক্ত ৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য এবং সৃষ্টপদে ২৫৭জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেন। এসময় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জিম্মি করে, প্রার্থীপ্রতি ১২ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিলেও তিনি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কোনো টাকা দেননি। সমুদয় টাকা তিনি পকেটস্থ করেন। অধিকাংশ অর্থ তার এপিএস আলমগীর সিদ্দিক টিটো, সাবেক পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মফিজুর রহমান মফিজের মাধ্যমে নিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র জানায়।
কথিত আছে, ঘুষের টাকা হাতে গুনে মিলাতে সমস্যা হওয়ায় এমপির এপিএস টিটো টাকা গোনার মেশিন কিনে আলোচনায় আসেন। কেশবপুরের হিজলডাঙ্গা শহীদ ফ্লাইট লে. মাসুদ মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের ১৬ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ৬৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা নেয়ার বিষয়ে এপিএস টিটোর বিরুদ্ধে কেশবপুর থানায় শিক্ষকরা অভিযোগ করলেও থানার ওসি এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করেননি।
২০২০ সালে সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক এমপির মৃত্যুর পর কেশবপুরের সংসদীয় আসনটি শূন্য হয়। এর পর উপনির্বাচনে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার কেশবপুরের এমপি নির্বাচিত হন।
কেশবপুর উপজেলায় বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজসহ মোট ১৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে মাধ্যমিক-নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ৭২টি, দাখিল-ফাজিল মাদ্রাসা ৫৬টি এবং কলেজ রয়েছে আটটি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৫টি বিদ্যালয়ে সৃষ্ট ও শূন্যপদে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মিলে মোট ২৫৭ জন নিয়োগ দেন শাহীন চাকলাদার। এসময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের জিম্মি করে আবেদনকারীদের মধ্যে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীদের চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে রয়েছে আয়া, নৈশপ্রহরী, অফিস সহায়ক, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এসময় প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ২০ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে বলে একাধিক প্রার্থী এই প্রতিবেদকে জানান।
নিয়োগের টাকা বুঝে নেয়া হয়: সূত্র বলছে, নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা শাহীন চাকলাদার সিংহভাগ নিতেন এবং বাকি টাকা তার এপিএস টিটো, মফিজুর রহমান ও সাবেক মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল ও তৎকালীন কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এমএম আরাফাত হোসেনের মধ্যে ভাগাভাগি হতো। নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি ওই সময় কেশবপুরে ওপেন-সিক্রেট থাকলেও ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাননি। অপরদিকে উপজেলার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় সে সময় নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান উপজেলা শিক্ষা অফিসার জিল্লুর রশীদ।
গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মফিজুর রহমান মফিজ, সাবেক পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
এদিকে, সাবেক এমপি’র এপিএস টিটোকে যৌথ বাহিনী আটক করলেও থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না দিয়ে ৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরণ করায় পরের দিনই আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। টিটো যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগে একটি প্রতিষ্ঠানের ১৮ শিক্ষকের কাছ থেকে ৬৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে গত ৩০শে আগস্ট কেশবপুর থানায় একটি অভিযোগ করা হলেও থানার তৎকালীন ওসি তার বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে তাকে ৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরণ করেন।
মধ্যকুল আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কফিল উদ্দীন বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে দুইজন কর্মচারী নিয়োগের জন্য অন্য খরচ বাদে সাবেক চাকলাদারের এপিএস টিটো তার কাছ থেকে ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছিল।
ইমান নগর এমজিবি দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার শরিফুল ইসলাম বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে দুইজন কর্মচারী নিয়োগে এমপির এপিএস টিটো ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন। হাসানপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার আব্দুর রউফ বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেনের প্রতিবাদ করায় ৪ মাস এমপি ও তার লোকজন তাকে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেয়নি। তিনি এসময় পালিয়ে ছিলেন।
হিজলডাঙ্গা শহীদ ফ্লাইট লে. মাসুদ মেমোরিয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক অধ্যক্ষ মশিয়ুর রহমান বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১৯জন শিক্ষকের কৃষি ডিপ্লোমার বেতন ছাড় করিয়ে দেয়ার কথা বলে তার মাধ্যমে সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদারের এপিএস আলমগীর সিদ্দিকী টিটো ৬৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা নেন। ২০২২ সালে চুয়াডাঙ্গা কৃষ্ণনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তিনজনকে পিয়ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ ছাড়া কেশবপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে দুইজন, বায়সা শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারজন, এবিজিকে ফাজিল মাদ্রাসায় সহকারী অধ্যক্ষসহ তিনজন, ভাণ্ডারখোলা দাখিল মাদ্রাসায় ২ জন, বারুইহাটি পাত্রপাড়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসায় ২ জন, বেগমপুর ইসলামিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসায় সহ-সুপারসহ ২জন, কেশবপুর দারুল উলুম মহিলা ফাজিল মাদ্রাসায় দুইজন, কেশবপুর বাহারুল উলুম কামিল মাদ্রাসায় তিনজন, হাজী আব্দুল মোতালেব মহিলা কলেজে দুইজন, এসএসজি বরণডালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারজন, ত্রিমোহিনী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে তিনজন, ত্রিমোহিনী দা. ইসলাম ফাজিল মাদ্রাসায় একজন, চাঁদড়া দাখিল মাদ্রাসায় দুইজন, এসএসজি বরণডালী দাখিল মাদ্রাসায় দুইজন, কপোতাক্ষ সম্মিলনী ডিগ্রি কলেজে চারজনসহ মোট ৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৫৭জনকে নিয়োগ দিয়ে এমপি শাহীন চাকলাদার আয় করেন প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কেশবপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এএসএম জিল্লুর রশীদ বলেন, শাহীন চাকলাদার এমপি থাকাকালে কেশবপুরে কতোজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কারণ আমি কেশবপুর আসার আগেও নিয়োগ হয়েছে। মাঝখানে আমি ছিলাম না। তারপর আমি আসার পরও নিয়োগ হয়েছে। তার ক্ষমতায় তিনিই নিয়োগ দিয়েছেন এবং লেনদেন যা হয়েছে তিনিই করেছেন। আমি শুধু দাখিল ও মাধ্যমিক স্তরের নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য ছিলাম মাত্র।